ঋণ ফেরত চায় রাশিয়া, জটিলতায় বাংলাদেশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:৩৩ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৫৪ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দেয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে বাংলাদেশকে তাগিদ দিচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ঋণ পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। ডলার সংকটের পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিকে সুদ দিতে পারছে না সরকার। এ কারণে ঠিকাদারের বিলও আটকে আছে। এমন বাস্তবতায় দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্পের গতি কমেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি বাবদ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছিল রাশিয়া। এই ঋণ সুদাসলসহ আট কিস্তি পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ঋণের ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ১০ কোটি ডলার এখনো বকেয়া। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এই জটিলতায় রাশিয়াকে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিতে পারছে না বাংলাদেশ। সংকট নিরসনে রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবল ও চীনের ইউয়ানে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
ইআরডি সূত্র জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বের করে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া এ প্রস্তাব দেয়। তবে রুবল বা ইউয়ানে পরিশোধের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করছে ইআরডি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি যখন অনুমোদন দেয়া হয় তখন আইন-কানুনের ওপর ভিত্তি করে কিছু চুক্তিও করা হয়। নতুন করে রুবল বা ইউয়ানে দিলে সেই চুক্তি পুনরায় সংশোধন করতে হবে। রুবল বা ইউয়ানে পরিশোধ করতে হলে পার করতে হবে কয়েকটি ধাপ। এর মধ্যে অন্যতম রুবল বা ইউয়ানও ডলার বিক্রি করে কিনতে হবে। কারণ রুবল বা ইউয়ানের তেমন কোনো শক্ত সোর্স বাংলাদেশের নেই। এছাড়া সব সময় রেট ওঠানামা করে। সেই হিসেবে অনেকটাই স্থিতিশীল ইউএস ডলার।
সুতরাং, এতে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। এর চেয়ে ডলারে পরিশোধ করা বাংলাদেশের জন্য সুবিধা। কারণ প্রচুর রেমিট্যান্স ডলারে আসে দেশে। এছাড়া এক্সপোর্টও হয় ইউএস ডলারে। এর বাইরে কোনো কারেন্সি পরিশোধ করতে হলে ডলার বিক্রি করে কেনা লাগবে। ইউয়ান ও রুবলে ঋণ পরিশোধে তিনটি বাধা দেখছে ইআরডি। প্রথমত চুক্তি সংশোধন করতে হবে। চুক্তির আবার কয়েকটা ধারা আছে। প্রথমে চুক্তি করা ছিল রাশিয়াকে ডলারে সুদ ও আসল পরিশোধ করা হবে। এটা পরিবর্তন করে নতুন করে লিখতে হবে রাশিয়াকে ডলার অথবা অন্য কোনো কারেন্সিতে সুদ ও আসল পরিশোধ করা যাবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে দুটি চুক্তি আছে রাশিয়ার ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের (ভিইবি) সঙ্গে। এই চুক্তিও বাতিল করতে হবে। রাশিয়ার যে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক এই প্রকল্পের অর্থ লেনদেন করে, সেই রুশ ব্যাংকটি তাদের সঙ্গে আপাতত লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলেছে বাংলাদেশকে। কারণ রাশিয়ার ওই ব্যাংক বৈশ্বিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যম সুইফটের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে।
সুতরাং, রাশিয়া যেভাবে চাচ্ছে চাইলেই দিতে পারবে না বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার ঋণের সুদাসল রুবলে পরিশোধের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা কয়েক দফা মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে যে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে, তার দায় কে নেবে তা ঠিক হয়নি।
রাশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে ইআরডির মতামতে বলা হয়েছে, একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে ঋণের ব্যয় ও ঝুঁকি অনেক বাড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়া রূপপুরের সুদ ও আসল নিজেদের মুদ্রা রুবল অথবা চীনের মুদ্রা ইউয়ানে পেতে চায়। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদনের সময় কিছু চুক্তি সই করা হয়।
চুক্তিতে বলা আছে, ডলারে পরিশোধ করা হবে। প্রথমে এটা সংশোধন করতে হবে। এছাড়া রুবল বা ইউয়ানের শক্ত সোর্স অমাদের নেই, তবে ডলারে আছে। সুতরাং, টাকার বাইরে যাই কেনা হবে তা ডলার দিয়েই কিনতে হবে। ভিইবি ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাহলে টাকা পরিশোধের নিরাপদ রুট কোথায়? রুবলে পরিশোধ করতে গেলে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। বাড়তি ব্যয় কে পরিশোধ করবে? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। এটি উৎপাদনে যাবে ২০২৪ সালে। রূপপুর প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩শ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বিনিময় হারে (ডলারপ্রতি ১০৫ টাকা ধরে) প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমান। রাশিয়া ঋণ দিচ্ছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার। এই ঋণের ৪৯৭ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে।
রাশিয়ার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু সুদ এবং এর পর থেকে সুদ ও আসল কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়া বাংলাদেশকে দুটি চিঠি দিয়েছে। প্রথম চিঠি দেয়া হয় গত ২৩ জুন। এতে দুই দেশের মধ্যে সই করা আন্তঃসরকার ঋণচুক্তির (আইজিসিএ) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়। এরপর গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেয়া হয়।
তবে অর্থনীতিবিদদের দাবি, যে চুক্তি আছে তাতেই সুদাসল পরিশোধ করা যৌক্তিক হবে। রুবলের রেট সব সময় ওঠানামা করে। সকালে এক রেট থাকে বিকেলে আরেক রেট। ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দিনে ওঠানামা করার রেকর্ড আছে।
সুতরাং, রুবলে পরিশোধ করা ঝুঁকি অনেক।
সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেভাবে চুক্তি আছে সেভাবে রাশিয়াকে সুদ ও ঋণ পরিশোধ করা ঠিক হবে। রুবলে পরিশোধ করা উচিত হবে না। রুবলের রেট সব সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। সকালে এক তো বিকেলে আরেক থাকে।
তবে ১০ কোটি ডলার যে কোনোভাবে পরিশোধ করা যায়, এতে লাভ-ক্ষতি খুব একটা বেশি নয়। তবে বড় ঋণটা পরিশোধ কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণে সরবরাহ করছে রাশিয়া। এই প্রকল্পে রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক ৩+ প্রজন্মের (থ্রি প্লাস জেনারেশন) ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করা হবে। প্রতিটি ১ হাজার ২শ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট স্থাপন করা হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ২০২৩ সালে এর প্রথম ইউনিট এবং পরের বছর ২০২৪ সালে দ্বিতীয় দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার কথা। এর পরে ২০২৬ সাল থেকে রাশিয়াকে সুদাসল পরিশোধ করবে সরকার। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে টানা ৬০ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।