ওষুধ কিনতেই পকেট ফাঁকা!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৩৩ পিএম, ১৬ জানুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:০৯ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
রাজধানী ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকার বাসিন্দা খাইরুল আলম। একটি মুদি দোকানে কাজ করেন। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্য চারজন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ছোট মেয়ের শারীরিক নানান জটিলতা থাকায় প্রতি মাসে চিকিৎসায় ব্যয় হয় বড় অংকের টাকা। সরকারি হাসপাতাল থেকে মেলে না সব ওষুধ। অ্যান্টিবায়োটিক বা কিছু দামি ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। এর মধ্যে দামও বেড়েছে কয়েক গুণ। টেস্টেরও খরচ আছে। স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে এসেছেন পারুল। থাকেন বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকায়। নিজে বাসাবাড়িতে কাজ করেন। স্বামী রিকশা চালান।
তিনি বলেন, ঠান্ডা, কাশি, জ্বর তো সব সময় লেগেই থাকে। মাঝে ছোট ছেলের ডেঙ্গু হওয়ায় তার পেছনে অনেক টাকা লেগে গেছে। ওষুধের দামও বেড়েছে অনেক। খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ফারহাতুলের চিকিৎসা খরচ চালাতে জমি বিক্রি করেছেন তারা বাবা। কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে তার চিকিৎসায়। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার বেশি ওষুধই প্রয়োজন হয়। নানান টেস্ট আর রক্ত দেয়ার খরচ তো আছেই।
ফার্মেসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক গরিব মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনতে আসেন। তবে ওষুধের দাম শুনে নেয়ার সাহস করেন না। অনেকে নিলেও অল্প করে নিতে চান। আমরা না দিতে চাইলেও তাদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক ও খুচরাভাবে দিতে হয়। প্রায় সব ওষুধেরই দাম বেড়েছে জানিয়ে তারা বলেন, আসলেই মানুষ অনেক কষ্টে আছে। এভাবেই সারাদেশের রোগাক্রান্ত মানুষ চিকিৎসা খরচে দিশেহারা। জীবনযাপনে প্রতিটি খাতেই বেড়েছে ব্যয়। সুস্থ থাকার জন্য যে চিকিৎসা ব্যয় তা বেড়েছে অনেক বেশি। দেশের নানা জায়গায় এরই মধ্যে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও। এ অবস্থায় চিকিৎসা করাতেই পকেট ফাঁকা হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মধ্যে থাকা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক বলেন, প্রতিটি ওষুধের দামই ৫০ থেকে ১০০ শতাংশও বেড়েছে। যেমন যে সিরাপ ছিল ২০ টাকা হয়েছে ৩৫ টাকা, অ্যান্টাজল ছিল ১০ টাকা হয়েছে ২০ টাকা। এমন কোনো ওষুধ নেই যেটার দাম বাড়ানো হয়নি। আগে যে ওষুধ ১০০ টাকা ছিল তা বেড়ে হয়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। এছাড়া যেসব ওষুধ বিদেশ থেকে আনা হয় তার আগের দামের তুলনায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের পুঁজি বাড়াতে হচ্ছে, কিন্তু সেই তুলনায় ক্রেতা পাচ্ছি না। এমনও হয় অনেক সময় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আমাদের কাছে ওষুধের দাম জানতে আসেন ক্রেতা। দাম বেশি দেখলে অনেক সময় ওষুধ পরে নেবেন বলে চলে যান কিংবা কিছু কেনেন কিছু বাদ দেন। পাশের নানজিবা ফার্মার কর্মচারী কামরুলও জানান ওষুধের আকাশচুম্বি দামের কথা।
তিনি বলেন, ওষুধ নিত্যপ্রয়োজনীয় হওয়ায় মানুষ কিনতে বাধ্য হয়। কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে মানুষের ওষুধ কিনতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের আয়োজনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ষষ্ঠ রাউন্ডের চূড়ান্ত ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে মানুষের চিকিৎসাখাতে ব্যক্তিগত ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেনসেস (ওওপি) আরও বেড়েছে। এ অতিরিক্ত ব্যয় ২০১৫ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। গত ২৪ বছরে স্বাস্থ্যখাতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতাও বেড়েছে। স্বাস্থ্যখাতে নিজ খরচের বড় অংশ (৬৭ শতাংশ) ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ২০২০ সালে নিজ খরচে ওষুধ কিনতে মানুষের ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৩৭ কোটি ২ লাখ টাকা টাকা। এছাড়া চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ব্যয় করেছে ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এছাড়া স্বাস্থ্যের প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় হয়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যার মূল্য দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৪৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। ওষুধের পেছনেই আউট অব পকেট ব্যয় মূল হলেও দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ওষুধের মূল্য। ওষুধ প্রশাসন স্বীকার করেছে, ওষুধের দাম আরও বাড়াতে তারা চাপে রয়েছেন। যেসব ওষুধের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ নেই সেসব ওষুধের দাম ওষুধ কোম্পানি থেকে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে দাম বাড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়ার কথা বললেও হাসপাতালগুলোতে দেখা যায় ওষুধ সংকট। এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে চাপ রয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধ আমরা তৈরি করি। দুই শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হয়। তাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চাপ সামাল দিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের নেয়া বিভিন্ন উপহার কমিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, বিশ্বে ক্রাইসিস চলছে। করোনা শেষ হওয়ার মধ্যেই আবার যুদ্ধ। সারা পৃথিবীতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ওষুধ কোম্পানির মালিকদের সংগঠন আমাকে বলে মিটিং করার জন্য। তার মানে ওষুধের দাম বাড়াতে চায়। এখানে আমাদের হস্তক্ষেপের একটু জায়গা আছে। ওষুধের দাম বাড়াবে ঠিক আছে, কিন্তু যে কারণে ওষুধের দাম বেশি আছে সেটা আগে তাদের ব্যাখ্যা করতে হবে। ওষুধের দাম তো অনেক জায়গায় কমানোর সুযোগ আছে।
জানা যায়, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে চিকিৎসাসেবা বিনামূল্যে দেয়া হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপর ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপাল। সবচেয়ে কম ব্যয় মালদ্বীপে। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ এক যুগেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। ব্যক্তির ব্যয় কমেনি বরং বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, শুধু ওষুধ নয়, রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। বাড়তি হাসপাতালে অবস্থান ও যাতায়াত খরচ। গত ছয় মাসে দুই দফায় ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি, দুর্নীতি কমানো ও নজরদারি বাড়ানো দরকার। তবে আউট অব পকেট খরচ বাড়ার পেছনে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল বলেন, আমাদের তথ্যে উঠে এসেছে, ধনী শ্রেণিতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার হার বেশি। নিজ খরচেই তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিশেষ করে গ্রাম ও শহরে নিম্নবিত্ত শ্রেণি যে পরিমাণ খরচ করে তার প্রায় আট গুণ বেশি খরচ করে ধনীরা।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে বলেন, পকেট খরচ (স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ) কমাতে হলে প্রাইভেটের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার বিদেশে বড় একটা অংশ চিকিৎসা নেয়, সেটিরও একটা প্রভাব এতে পড়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রপাতিসহ অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এজন্য তদারকি ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে।