ডলার সংকটের মুখে বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২ বিলিয়ন ডলার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫১ পিএম, ৫ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৫৮ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিদ্যুৎ খাতে গত কয়েক বছরে নেয়া হয়েছে বেশকিছু বড় প্রকল্প। তবে বেশিরভাগ প্রকল্পেই সহজ শর্তের ঋণ পাওয়া যায়নি। ফলে নেয়া হয়েছে কঠিন শর্তের বায়ার্স ক্রেডিট বা ইসিএ (এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি) ঋণ। গ্রেস পিরিয়ডসহ এসব ঋণ ১২-১৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে। তবে সাম্প্রতিক ডলার সংকটে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না ঋণের কিস্তি।
এসব ঋণের সুদহার ছিল ছয় মাস মেয়াদি লাইবর (লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট) প্লাস ৩-৪ শতাংশ। তবে গত এক বছরে লাইবর বেড়ে গেছে প্রায় ১৭ গুণ। এতে ঋণের সুদ পরিশোধ নিয়েও চাপে পড়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। সুদ ও আসল মিলিয়ে বছরে বিদ্যুৎ (সরকারি ও বেসরকারি) খাতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে দুই থেকে সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার।
তথ্যমতে, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে কঠিন শর্তের ঋণ রয়েছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার কোম্পানি পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণ নিয়েছে প্রায় এক হাজার ৮০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৭৮০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ এক হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আট প্রকল্পে ইসিএ ঋণ এক হাজার ৮০ মিলিয়ন ডলার, আশুগঞ্জ ও ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬১০ মিলিয়ন ডলার, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং বি-আর পাওয়ারজেনের ঋণ ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ রয়েছে চার হাজার ৪২৯ মিলিয়ন ডলার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানির ঋণে বাংলাদেশ সরকারের সভরেন গ্যারান্টি দেয়া ছিল। ফলে এসব ঋণের সুদহার ছয় মাস মেয়াদি লাইবর প্লাস (গড়ে) ৩ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে লাইবর ছিল ০.৩১ শতাংশ। এতে গড়ে এসব ঋণে সুদ দিতে হতো ৩.৩১ শতাংশ। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে লাইবর বেড়ে হয়েছে ৫.১২ শতাংশ। ফলে এ সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৮.১২ শতাংশ।
এদিকে বেসরকারি ঋণে সভরেন গ্যারান্টি না থাকায় সুদহারও বেশি। বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি এসব ঋণের গড় সুদহার ছিল লাইবর প্লাস ৪-৪.৫ শতাংশ। ফলে বেসরকারি ঋণের জন্য আগে সুদ গুনতে হতো ৪.৩১ থেকে ৪.৮১ শতাংশ। তবে লাইবর হার বেড়ে যাওয়ায় এ সুদের হার গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ৯ শতাংশে। এতে ইসিএ তথা বায়ার্স ক্রেডিটের সুদ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতই।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎ খাতের এসব ঋণ গড়ে ১২ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এতে বছরে আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয় প্রায় এক হাজার ১৪০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতের ৩৭০ মিলিয়ন ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। আর সরকারি খাতের সুদ বাবদ গুনতে হবে প্রায় ৭৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতে সুদ বাবদ ৪০০ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে বছরে।
যদিও ডলার সংকটে ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গত মাসে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তিন সংস্থার ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক চায়নার (আইসিবিসি) ঋণের কিস্তি দেয়ার কথা ছিল বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রসারণ ও ঘোড়াশাল গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র (৩য় ইউনিট) নির্মাণ প্রকল্পের। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে।
এগুলোর মধ্যে বড়পুকুরিয়ার কিস্তি পরিশোধে ১৫ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার দরকার ছিল। ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে এ ঋণ শোধ করার কথা থাকলেও সোনালী ব্যাংক ডলার সরবরাহে ব্যর্থ হয়। গত ৩ জানুয়ারি এ কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। কিস্তি পরিশোধ বিলম্ব করায় ডেফার্ড সুদ দাবি করেছে আইসিবিসি। তবে সে সুদ মওকুফে গতকাল আইসিবিসিকে চিঠি দিয়েছে পিডিবি।
এদিকে রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে ঘোড়াশালের ঋণের ১৫ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার জন্য ব্যাংকটি এ ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করে। ৩০ ডিসেম্বর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি বাবদ ১৬ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের কথা ছিল, যা তারা ডলার সংকটের কারণে বিলম্ব করে।
পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুৎ খাতকে সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বেসরকারি খাতেও বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ একদিকে বেড়ে গেছে সুদহার, আরেকদিকে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এভাবে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ বিলম্বিত হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।