নানা সংকটে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারাখানা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪৩ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:২৮ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ছোট-বড় ৪৬৪টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সংকট অব্যাহত থাকলে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বালানির অভাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এর মধ্যে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয় শিল্প খাত। আর ডলার সংকট এই ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেয়। কারণ ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে অনেক শিল্পকারখানা সময়মতো শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। এ ছাড়া কারখানায় কাজ না থাকায় মাসের পর মাস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা টানতে গিয়েও ব্যাংকঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে অনেক উদ্যোক্তা। এ ধরনের নানামুখী সংকটে পড়েই গত এক বছরে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। দেশের শিল্প খাতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে শিল্পপুলিশ। সরকারের এই সংস্থা দেশের শিল্পাঞ্চলকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছে। এগুলো হচ্ছে- আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা। গত এক বছরে শিল্পপুলিশের হাতে আসা প্রতিবেদনগুলোর সূত্রে দেশে কারখানা বন্ধের তথ্যটি জানা গেছে।
শিল্পপুলিশের তথ্যমতে, খাতভিত্তিক শিল্পকারখানার দিক থেকে গত এক বছরে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে ৫৮টি। একই সময়ে ১৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর আওতাধীন। তিনটি কারখানা বন্ধ হয়েছে টেক্সটাইল শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর আওতাধীন। এ ছাড়া বেপজার সদস্যভুক্ত কারখানা বন্ধ হয়েছে আটটি এবং অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ৩৭৬টি।
অন্যদিকে, অঞ্চলভিত্তিক সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে এক সময়ের শিল্পনগরী খুলনায়। এ অঞ্চলে গেল এক বছরে মোট ১৫১টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া সবচেয়ে কম বন্ধ হয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এ অঞ্চলে ৪টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। আশুলিয়া অঞ্চলে গেল এক বছরে মোট ৮৮টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানা ১৩টি, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা পাঁচটি এবং অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ৭০টি। গাজীপুর অঞ্চলে মোট বন্ধ হয়েছে ১৩৪টি কারখানা। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানা ২৫টি, বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা ৬টি, টেক্সটাইল একটি ও অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ১০২টি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোট শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানা ১৫টি, বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা চারটি, বেপজার দুটি, অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ৪৭টি। নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে গত এক বছরে মোট ১৯টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে তিনটি, বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা চারটি। এ সময়ে টেক্সটাইল বন্ধ হয়েছে দুটি। এ ছাড়া বেপজার ৪টি ও অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া বন্ধ হওয়া ১৫১টি কারখানার মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা দুটি, বেজার দুটি ও অন্যান্য ১৪৭টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। এ বিষয়ে শিল্পপুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. মাহবুবর রহমান বলেন, যেসব কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে বৈশ্বিক কারণটাই বড় মনে হচ্ছে। যে কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বিক্ষোভসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পপুলিশ মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘদিন ধরে শিল্পপুলিশ এ কাজটি ভালোভাবে করে আসছে।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, অনেক পোশাক কারখানা মালিক করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। টেনেটুনে অনেক কষ্টে চালু রাখলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করে দিয়েছে। একদিকে বায়ার (ক্রেতা) না থাকা; অন্যদিকে ব্যাংকঋণের সুদে আটকে পড়া। এ ছাড়াও গ্যাস, বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি- সবকিছু মিলিয়ে মালিকরা বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করেছেন।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ^বাজারে পোশাকের ক্রেতা কমে যায়। বিদেশি ক্রেতা (বায়ার) না পাওয়া এবং অর্থসংকটে চাহিদা অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ করতে না পারায় অনেক বায়ার ছুটে যায়। এ ছাড়াও অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করেছেন মালিকরা।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, এতগুলো শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের জন্য ক্ষতি। হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন- যেটা খুবই দুঃখজনক। এসব শ্রমিক এখনো সম্পূর্ণ পাওনাদি পায়নি। অনেক মালিক কারখানার মেশিনারিজ বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধ করেছেন। আবার কেউ কেউ কম-বেশি করে বেতন দিয়েছেন। সরকারের উচিত হবে এ কারখানাগুলো চালু করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া। এতে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে।
গত ৫ আগস্ট দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে তৈরি পোশাক খাত, সিমেন্ট খাতসহ সব ধরনের শিল্প খাতে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ২০-৫০ শতাংশ। আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৪-২০ শতাংশ। অবশ্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসে। এর আগে ২০২১ সালের শেষার্ধ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। এ সময় পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়াও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
কাঁচামালের এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার মধ্যেই ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে করে খাদ্যপণ্যসহ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে। বিশে^র প্রায় সব দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। শিল্পের কাঁচামাল ও জাহাজে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
শিল্প খাতের এখনকার বিপদ ডলার সংকট। প্রায় প্রতিদিনই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের আমদানি-রফতানিতে রেকর্ড ব্যবধান তৈরি হয়। এর ফলে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডলারের অভাবে ঠিকমতো আমদানিও করা যাচ্ছে না। দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম বাড়ায় রফতানি আয়ের এই প্রধান খাত এখন সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে।
বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, গত দেড় বছরে সুতার দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ, মালবাহী পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ, রঙ-রাসায়নিক খরচ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এ সময় ন্যূনতম মজুরিও বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যয় বেড়েছে ৪০-৪৫ শতাংশ। শ্রমিকের কম মজুরি, বন্ডেড সুবিধা ও নগদ প্রণোদনার সুবিধা নিয়ে দেশে যে রফতানিশিল্প গড়ে উঠেছে, জ্বালানি ও কাঁচামালের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জন্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। তবে পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশের মতো। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতির কারণে সবাই চিন্তায় আছেন, কবে কার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। খরচ কমানোর মতো পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এখন যে অবস্থা চলছে তাতে মুনাফা দূরের কথা, টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেছেন, কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে পড়বে, কিছু কারখানা নতুন করে চালু হবে- এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সংকটময় পরিস্থিতিতে সাধারণত মাঝারি শিল্পকারখানাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিল্পপুলিশের তথ্য অনুযায়ী যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে, সবগুলোই একই কারণে বন্ধ হয়েছে মনে করার কারণ নেই। অনেক সময় পরিচালনায় অদক্ষতা এবং এ কারণে ব্যাংক ঋণভারে জর্জিত হওয়ার কারণেও কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তবে জ্বালানি ও ডলার সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। তার আগে কোন খাতে কী ধরনের কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তার কারণগুলো যাচাই করে সরকারের পক্ষে যা করার তা করা উচিত।