বছরজুড়ে সংসারে টানাপোড়েন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৩৩ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫৬ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ছিল না মানুষের। চাল, ডাল, তেল, আটাসহ বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব সরাসরি পড়ে নিত্যপণ্যে। করোনার ধকল কাটিয়ে অনেকের বেতনও ফেরেনি আগের অবস্থানে। এরই মধ্যে পণ্যমূল্য বাড়ায় সংসারে টানাপোড়েন চলছে সারা বছর। বেশি ভুগেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ। চলতি বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছিল, পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন করে বিপদে পড়েছে ২৯ শতাংশ মানুষ। যেখানে বছরের শুরুতে দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের জীবনমানের ওপর সেই চাপ ছিল। আর বছর শেষে এ হিসাব করলে হিসাব নিশ্চয় আরও পরিবর্তন হবে। যদিও সরকার শেষ সময়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার দাবি করেছে, তবে সেটি মানতে নারাজ বিশ্লেষকরা। সব মিলে বছরজুড়েই (২০২২) দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল বেশ আলোচিত বিষয়। গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। যে কারণে আগস্ট মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। সেখানে বিবিএসের হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমেছে। এর আগে আগস্ট মাসে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়, যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরে সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমেছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি। এদিকে বছরজুড়ে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ও এর প্রভাবে বাংলাদেশে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানিতে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এর মধ্যে দেশে এক দফা ডিজেলের দাম বাড়ায় বাড়তি পরিবহন খরচ ও পণ্য উৎপাদনে গ্যাসের সংকটে পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি বছরজুড়ে ছিল নাজুক। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট থেকে শুরু করে ডলারের সংকট হয়েছে সেটা সত্য। তবে সেসব কারণ দেখিয়ে যে হারে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে সেটা বেশি।’ তিনি বলেন, ‘বাজারের এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এখন হুট করেই তৈরি হয়নি। করোনা পরিস্থিতির পর থেকেই ধীরে ধীরে হচ্ছে, কিন্তু সেটা সরকার আমলে নেয়নি, যা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’
মোটা চাল ১০, সরুতে ১২ টাকা বাড়তি :
গত বছর ঠিক এ সময় ৪৬-৪৮ টাকার মধ্যে যে কোনো জাতের মোটা চাল কেনা যেত। এখন সেটা ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকা। কোথাও কোথাও ৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সরু চালের দাম (মিনিকেট) ৬০ টাকার মধ্যে ছিল, যা এখন ৭০-৭৫ টাকা। ভালো মানের নাজিরশাইলের দাম ৮০ টাকায় ঠেকেছে। একই ধরনের তথ্য দিচ্ছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংস্থাটি বলছে, চালের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে মানভেদে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। যদিও চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য বলছে, টানা কয়েক বছর দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হচ্ছে। গত অর্থবছর (২০২১-২২) দেশে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি মৌসুমেও উৎপাদন হচ্ছে এর কাছাকাছি। সে অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। চাল সংকট আমাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাহিদা মেটাতে আমদানির জন্য মরিয়া সরকার। বেসরকারি খাতকেও নানান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে চাল আমদানির জন্য।
আটা-ময়দার দাম দ্বিগুণ :
২০২১ সালের শেষে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। একইভাবে ময়দার দাম ৪০-৪২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ দুই পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। টিসিবির তথ্য বলছে, বিগত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে ময়দার দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত। চালের পাশাপাশি আটার দাম বাড়ায় প্রধান দুটি খাদ্যশস্যের জন্যই দারুণ চাপে পড়েছে মানুষ। বাংলাদেশের বাজারে দুটি পণ্যের দামই দাঁড়িয়েছে ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগে মানুষ চালের দাম বাড়লে বিকল্প হিসেবে আটা-ময়দা বেছে নিতো। এবছর সে সুযোগও নেই।
তেল-চিনি নিয়ে অস্বস্তি সারা বছর :
এ বছর তেল ও চিনির দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। আবার বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। টিসিবি বলছে, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন গত বছরের তুলনায় সাড়ে ২২ শতাংশ বেশি। আর চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ। গত বছর এক কেজি চিনির দাম ৭৫ টাকার মধ্যে থাকলেও সেটি এখন ১১৫ টাকা। এদিকে বছরজুড়ে বারবার তেল-চিনির দর বাড়িয়েছে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো। তবে নির্ধারিত দর সরকার অনুমোদন দিয়েছে কি না সেটা নিয়ে সব সময় অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু দাম বাড়ানো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নীরব থাকার মধ্যে তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো নিজেরাই দাম বাড়িয়ে বিভিন্ন দামে বিক্রি করেছে সারা বছর।
ভুগিয়েছে ডাল-ছোলা :
আটা-ময়দা, তেল-চিনির মতো আরেক আমদানিনির্ভর পণ্য ডালের বাজারও শেষ সময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নভেম্বর থেকে বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। খুচরা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডালের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে।
তাতে শেষ সময় নিম্ন আয়ের মানুষ যখন মাছ-মাংস কিনতে হাঁসফাঁস করছে, তখন ডালের এই বাড়তি দাম তাদের সংসার খরচ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। টিসিবির হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে বড়, মাঝারি ও ছোট দানার মসুর ডালের দাম প্রতি কেজি যথাক্রমে ১৫, ২৪ ও ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৯৭ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। বাজারে খোলা মসুর ডালের পাশাপাশি সুপারশপ বা বড় দোকানে প্যাকেটজাত ডাল পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত মসুর ডাল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ১২০ টাকার মধ্যে ছিল। অন্যদিকে বছর ব্যবধানে ছোলার দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে এখন হয়েছে ৮০-৯০ টাকা, যা গত বছর ৬৫-৭০ টাকার মধ্যে ছিল।
স্বস্তি ছিল না সবজি, মাছ-মাংসের দামে :
ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত বছরব্যাপী চড়া ছিল সবজির দাম। গরুর মাংসের দাম এক বছরের ব্যবধানে এক শ-দেড় শ টাকা বেড়েছে। সঙ্গে চড়া ছিল সব মাছের দামও। বছরের বেশিরভাগ সময় ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি কেনা যায়নি। একইভাবে বছরের মাঝামাঝি এসে অন্য মাছের মতো সবচেয়ে কম দামি মাছ পাঙাশের দামও বেড়েছে। চাষের পাঙাশ এখন ১৮০ টাকা, দর বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার মতো। তেলাপিয়া ১৮০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটা এখন ২২০ টাকা। বাজারে বোয়াল, বাছা, কাজলি, চিংড়ি, আইড়, বাতাসিসহ বিভিন্ন দেশি মাছ ৬শ টাকার নিচে নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তি।