হুন্ডির থাবায় প্রবাসী আয়ে ধস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:২৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৫৫ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্রবাসী আয় ধসের মূলে রয়েছে হুন্ডি। প্রবাসীরা ডলারের বিপরীতে একটু বেশি টাকা পেলেই বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করে রেমিট্যান্স ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। অক্টোবর মাসে আরও খানিকটা কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখে ডলারে ঠেকে। কিন্তু চলতি বছর শুরু হয়েছিল ভালো রেমিট্যান্স প্রবাহ দিয়ে। জুলাই মাসে রেমিট্যান্স আসে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, আর আগস্ট মাসে আসে ২০৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ সময় প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের দাম বেঁধে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) শীর্ষ নেতারা ১১ সেপ্টেম্বর এক সভায় প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৮ টাকা বেঁধে দেন। এ সময় রফতানি আয়ে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেয়া হয় ৯৯ টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দাম বেঁধে দেয়ার কারণে ডলারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হুন্ডি মার্কেটের দখলে। তারা বলছেন, এর আগে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে যার যার মতো করে ডলার কিনেছে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেমন কিনেছে, আবার হুন্ডি মার্কেটেও নিজেদের মতো দাম দিয়ে ডলার কিনেছে। ডলারের দাম যখন বেঁধে দেয়া হয়েছে, ব্যাংকগুলো আর নির্ধারিত দামের বেশি দরে ডলার কিনতে পারেনি। অন্যদিকে ডলারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে কিনেছে হুন্ডি মার্কেট। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলো যেমন ডলারের কেনার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, অন্যদিকে একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছে হুন্ডি মার্কেট। এর প্রভাব পড়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রবাসী আয়ে।
প্রবাসী আয়ের ধসের পেছনে ডলারের দাম বেঁধে দেয়া কাজ করেছে। একটু বেশি টাকা পাওয়ার জন্য প্রবাসীরা হুন্ডির আশ্রয় নিয়েছেন, বলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসী আয় এসেছিল একশ কোটি ডলার। শেষের ১৫ দিনে কমে ৫০ কোটি ডলারে ঠেকে।
ডলারের দাম বেঁধে দেয়া ছাড়া এ সময় প্রবাসী আয় হ্রাসের মতো কোনো ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসে ঘটেনি। এই সময়ে বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এবং যেসব দেশে গেছে, সেই সব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ার যৌক্তিক কারণ ছিল। উল্টো ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির আশ্রয় নিয়েছে, বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, এ সময়ে বিদেশগামী মানুষের প্রায় আশি ভাগই গেছে সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান ও আশপাশের এই সব দেশে। এসব দেশে যুদ্ধ বা অন্য কারণে নেতিবাচক অবস্থায় পড়তে হয়নি। বরং এসব দেশ সুবিধাভোগী। এসব দেশে মূল্যস্ফীতি কম, জীবন নির্বাহের খরচ কম। ফলে প্রবাসী আয় না কমে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম বেঁধে দেয়া।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের পরের মাস প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্থে বৃদ্ধির ধারায় আছে। এটা সম্ভব হয়েছে কিছু ব্যাংক প্রবাসী আয়ের ডলার কেনার ক্ষেত্রে বাফেদার বেঁধে দেয়া দর মানছে না। কিন্তু ভালো ব্যাংকগুলো এখনো বাফেদার নির্দেশনা মানছে। এর ফলে এই সব ব্যাংক ডলার সংকটে আছে। আগামীতেও এসব ব্যাংকের ডলার সংকট শিগগিরই কমার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না, যোগ করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক অর্থনীতিবিদ।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করতে হলে প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া ও নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা, মানি ট্রান্সফার ফি ফ্রি করে দেয়া, পাঠানো সহজ ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে প্রবাসী আয় পাঠানোর ব্যবস্থাতে কিছুটা কাজ হবে। তবে পুরস্কার সম্মাননা আপাতত প্রবাসী আয়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন তিনি।