কর্ণফুলী পেপার মিলে পুরোপুরি বন্ধ উৎপাদন : ৩ হাজার টন কাগজের ক্রেতা নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:১৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:১১ এএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কাগজ উৎপাদন কারখানা কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম)। এক সময়ের জনপ্রিয় এ কারখানাটি রুগ্ন যন্ত্রপাতি, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তহীনতা, পাল্প সংকট প্রভৃতি কারণে এখন পুরোপুরি বন্ধ। সবশেষ পুরোনো কাগজ থেকে কিছু উৎপাদন হয়েছিল গত আগস্ট মাসে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ কারখানাটি দেনায় জর্জরিত। এর মধ্যে আবার আছে তিন হাজার টন অবিক্রীত কাগজের বোঝা। দেশে চরম কাগজ সংকটের সময়ও পাঠ্যবই ছাপার উপযোগী এসব কাগজ কাজে লাগানো হচ্ছে না। ঘুরে দাঁড়াতে নতুন প্ল্যান্ট বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মিল কর্তৃপক্ষ বলছে, পুরোনো যন্ত্রপাতিগুলো প্রায় অকেজো হওয়ার পথে। অনেকগুলো মেশিন অকেজো হয়ে গেছে। তাই মিলের বর্তমান স্থাপনার মধ্যে নতুন প্ল্যান্ট বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন প্ল্যান্ট স্থাপনে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম চলছে। চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে।
কর্ণফুলী পেপার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী স্বপন কুমার সরকার বলেন, আমাদের প্ল্যান্টটি অনেক পুরোনো। তাছাড়া পাল্পের সংকট রয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশীয় সোর্স থেকে পাল্প পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশ থেকেও আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে পাল্পের দামও অনেক বাড়তি। যে কারণে এখন প্ল্যান্ট বন্ধ। কেপিএম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে মিলটি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন ও ইতালির সহযোগিতা এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত হয়। কারখানার বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৫৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ওই সময় পূর্ব ও পন্ডিম পাকিস্তানের চাহিদার প্রায় শতভাগ কাগজ সরবরাহ করা হতো কর্ণফুলী পেপার মিল থেকেই। পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থাপনা জটিলতায় ১৯৬৪ সালে দাউদ গ্রুপের কাছে মিলটি বিক্রি করে পাকিস্তান সরকার। প্রতিষ্ঠানটি মিলের আধুনিকায়ন করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা কর্ণফুলী পেপার মিল অধিগ্রহণ করে। ১৯৯০-৯১ সালের দিকেও কর্ণফুলী পেপার মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩০ হাজার টন। বাংলাদেশেও কর্ণফুলী পেপার মিলের উৎপাদিত কাগজ খুবই জনপ্রিয়তা পায়। তবে বিগত দুই যুগের কাছাকাছি সময় থেকে দেশে বেসরকারিভাবে পেপার মিল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কাগজ আমদানি শুরু হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে কেপিএম। সংকট তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় বৃহৎ কাগজ কলটিতে। ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় কর্ণফুলী পেপার মিলের কেমিক্যাল প্ল্যান্ট। জানা যায়, নিজস্ব সোর্স থেকে সংগৃহীত বাঁশ ও পাল্পউড (নরম কাঠ) দিয়ে মন্ড তৈরি করা হতো কেপিএমে। সেই মন্ড দিয়েই তৈরি হতো কাগজ। লেখার কাগজ, মুদ্রণের কাগজ, করোগেটেড বোর্ড, মোমের প্রলেপযুক্ত কাগজ, আঠাযুক্ত ফিতা ও বিটুমিন কাগজ তৈরিতে সক্ষম কর্ণফুলী পেপার মিল। মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, মিলের কাঁচামাল হিসেবে নিজস্ব কূপ এরিয়ায় স্থানীয়ভাবে বাঁশ উৎপাদন হয়। ৪-৫ টন বাঁশ থেকে এক টন পাল্প তৈরি করা হয়। বাঁশ থেকে কাগজ উৎপাদনে প্রতি টনে ১৮-২০ হাজার টাকা ব্যয় হতো। ২০১৭ সালে নানান সমস্যা দেখিয়ে নিজস্ব কূপ থেকে আহরিত কাঁচামাল বাঁশ ও পাল্পউড দিয়ে কাগজ উৎপাদন বন্ধ করে কেপিএম। এতে বন্ধ হয়ে যায় নিজেদের কেমিক্যাল প্ল্যান্টও (সিসি প্ল্যান্ট)। বাঁশ ও পাল্পউড সংগ্রহ বন্ধ করে পুরোনো কাগজ ও আমদানি করা পাল্প ব্যবহার করার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া বিদেশি পাল্প সরবরাহের জন্য টেন্ডার করে কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) দিলেও সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হন সরবরাহকারীরা। আবার নতুন করে টেন্ডার ডাকা হলেও অর্থ সংকট থাকায় নতুন সরবরাহকারীও পাচ্ছে না কেপিএম। গত অর্থবছর (২০২১-২২) পাল্প আমদানির জন্য তিন দফা টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কেউ টেন্ডারে অংশ নেননি। ফলে পাল্পের অভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটির। নিজেদের পাল্প তৈরির প্ল্যান্ট বন্ধ থাকায় মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতিও অকেজো হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
জানা যায়, কর্ণফুলী পেপার মিলে বর্তমানে ২২০ জনের অধিক স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মকর্তা রয়েছেন। অস্থায়ী লোকবল রয়েছে সাড়ে তিনশ জনের মতো। বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের বেতনসহ প্রতিষ্ঠানটির মাসিক খরচ পাঁচ কোটি টাকার মতো। কর্ণফুলী পেপার মিল সিবিএ সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, পাল্প সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন বন্ধ। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারেও পাল্প সংকট। যে কারণে আমাদের কারখানাও সংকটে পড়েছে। গত দুই বছরে উৎপাদিত প্রায় তিন হাজার টনের মতো কাগজ অবিক্রীত রয়েছে। বর্তমানে বিসিআইসি থেকে ঋণ নিয়ে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে।
নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ : কেপিএম কারখানার জায়গায় একটি নতুন কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিসিআইসি। এরই মধ্যে ‘মেসার্স চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি), চায়না’র সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে কেপিএম। পাশাপাশি কেপিএম এবং পেপারভিত্তিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট স্থাপনে কারিগরি ও আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কাজ করছে একটি প্রতিষ্ঠান। নতুন কারখানার মধ্যে ইন্টিগ্রেডেট পেপার মিলসহ বনায়ন, সোডা অ্যাশ প্ল্যান্ট, সোডিয়াম সালফেট প্ল্যান্ট, বেসিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট (কাস্টিক সোডা, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ব্লিচিং আর্থ, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড, ফসফরিক অ্যাসিড ইত্যাদি) এবং সিনথেটিক পলিস্টার ফাইবার প্ল্যান্ট রয়েছে। কর্ণফুলী পেপার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বপন কুমার সরকার বলেন, ‘কেপিএমে নতুন একটি প্ল্যান্ট বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু কেপিএম অনেক পুরোনো মিল তাই আমরা নতুন মিলটি বসানোর দিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
অবিক্রীত তিন হাজার টন কাগজ : দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় কেপিএম। গত কয়েক বছর আগে থেকে সংকট এড়াতে সরকারি প্রয়োজনের সব ধরনের কাগজ কেপিএম থেকে কেনার নির্দেশনা দেয় সরকার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তাদের বইয়ের জন্য সব কাগজ কেপিএম থেকে সংগ্রহ করতো। প্রতি বছর এনসিটিবি কর্ণফুলী থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টন কাগজ নিতো। এনসিটিবিকে প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহ দেয়ার লক্ষ্যে অর্ডার ছাড়াই প্রায় পাঁচ হাজার টন কাগজ তৈরি করে কেপিএম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এনসিটিবি এক হাজার টন কাগজের অর্ডার দেয়। পরবর্তী সময়ে দুই অর্থবছরে কাগজ অর্ডার বন্ধ করে দেয় এনসিটিবি। যে কারণে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার টন কাগজ নিয়ে বিপাকে পড়েছে কেপিএম।
কেপিএমের মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) প্রকৌশলী মঈদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পাল্পের অভাবে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তবে আগের উৎপাদিত প্রায় তিন হাজার টন কাগজ এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেপিএমের এক কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবির জন্য কাগজগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এসব কাগজ অন্য প্রতিষ্ঠানে তেমন ব্যবহার হয় না। যে কারণে সহজে বিক্রি করা যাচ্ছে না।