বছরের শুরুতেই আসছে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩০ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে গ্রাহকদের নতুন বছরের শুরুতেই বিদ্যুতে বাড়তি খরচ গুনতে হবে। এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে ২০ থেকে ২৩ শতাংশ বাড়ানোর আবদার করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এই প্রস্তাবের ওপর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আয়োজনে আগামী ৮ জানুয়ারি গণশুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সম্প্রতি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিইআরসি’র কাছে। তাদের এই প্রস্তাবের ওপর আগামী ৮ এবং ৯ জানুয়ারি গণশুনানি করবে কমিশন। গত ১৩ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও গ্রাহকের কথা বিবেচনা করা হবে। সরকার ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে বলেও জানান তিনি। ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়ানো হবে, নাকি সিস্টেমের ত্রুটি ঠিক করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা কিছু করা হচ্ছে ভোক্তার কথা চিন্তা করেই করা হচ্ছে। গত ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত খুচরা বিদ্যুতের দাম বেড়েছিল ১০৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সর্বশেষ খুচরা দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। চলতি বছরের গত ২১ নভেম্বর পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৩ পয়সা বাড়ায় বিইআরসি। এরপরই খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিতরণ কোম্পানিগুলো।
বিইআরসি’র এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বিদ্যুতের খুচরা মূল্য পুনঃনির্ধারণের আবেদন করেছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পিডিবি প্রতি ইউনিট খুচরা বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৩ পয়সা করার আবেদন করেছে। না হলে এই অর্থবছরে ২ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা লোকসান হবে। একই সঙ্গে কোম্পানিটি ডিমান্ড চার্জ ও নিরাপত্তা জামানত ৫০ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে। আরইবি ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এতে প্রতি ইউনিটে দাম বাড়বে ১ টাকা ৩৫ পয়সা। দাম না বাড়লে এই অর্থবছরে এক হাজার ৩৪১ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে বলে সংস্থাটি দাবি করেছে। পল্লী এলাকার জনগণের বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে বাণিজ্যিক গ্রাহক করার আবেদন করেছে। এছাড়া ইটভাটা ও দুগ্ধ শীতলকরণ যন্ত্রকে শিল্প গ্রাহকের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসি ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে। দাম না বাড়ালে আগামী বছরের প্রথম ছয় মাসে এক হাজার ১০৯ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে ডিপিডিসি দাবি করেছে। ডিপিডিসি প্রি-পেইড গ্রাহকদের রিবেট সুবিধা প্রত্যাহার, প্রি-পেইড গ্রাহকদের নিরাপত্তা জামানত যুক্ত করা, বস্তির গ্রাহকদের জন্য নির্দিষ্ট হার নির্ধারণ এবং সড়কবাতির বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। রাজধানীর বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা অন্য কোম্পানি ডেসকো ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। দাম না বাড়ালে আগামী বছরের প্রথম ছয় মাসে ৯৫৬ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে কোম্পানিটি দাবি করেছে। পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকো ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে। দাম বাড়ানো না হলে এই অর্থবছরে কোম্পানিটির ৫৬৬ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে জানিয়েছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিদ্যুৎ বিতরণকারী নেসকো খুচরা দাম ৭ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৩২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে। দাম না বাড়ালে এই অর্থবছরে ৫৩৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে বলে নেসকো জানিয়েছে।
তথ্যমতে, বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে রয়েছে। ডিপিডিসি’র ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে লাভ করেছে ১৬৬ কোটি টাকা। ডেসকো ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৩ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের মুনাফা করেছে ৬৬ কোটি টাকা। আরইবি ৮০টি সমিতির ২০২০-২১ অর্থবছরের নিট লাভ ২০ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হয় ১০৬ কোটি টাকা। ওজোপাডিকোর ২০২০-২১ অর্থবছরের নিট লাভ ২৪ কোটি টাকা। কোম্পানিটি ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসান গুনেছে সাত কোটি টাকা। নেসকোর ২০২০-২১ অর্থবছরের লাভ প্রায় ১৮ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ হলে খরচ কমে আসবে। তখন দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। তা না করে গ্রাহকের পকেট কাটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই দুঃসময়ে বাজারে গ্রাহকের ওপর আর বোঝা না চাপানোর দাবি জানান তিনি। এদিকে গণশুনানি ছাড়াই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে সরকারে হাতেই। শুধু গণশুনানি নামে মাত্র। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের যে বিধান রয়েছে তাতে শুনানির পর ৯০ দিন হাতে থাকে। কিন্তু এখন তা আর লাগবে না। সরকারের ইচ্ছা করলেই দ্রুত দাম নির্ধারণের কথা বলে চলতি মাসেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি জ্বালানির দাম সমন্বয় করার বিধান রেখে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) অধ্যাদেশ ২০২২ খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর আইনগত ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের আগে অংশীজনদের নিয়ে গণশুনানি করত বিইআরসি।