দেশ ছাড়ছেন ঋণখেলাপিরা, ঠেকাতে পুলিশের সহায়তা কামনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:১৩ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০১:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ ফেরত দেয়া হচ্ছে না। কেউ কেউ আবার বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। কেউ ঋণখেলাপি হয়ে দেশত্যাগের পথ খুঁজছেন। ইতিমধ্যে অনেকে পালিয়ে গেছেন। একবার পালিয়ে গেলে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে অর্থ আদায়। এমন পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপি গ্রাহকদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। তাদের বিদেশে পালানো ঠেকাতে পুলিশের সহযোগিতা চাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) ব্যাংকের গ্রাহক মোহাম্মদ আলী। খেলাপির অভিযোগে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে তার নামে মামলা করে আইএফআইসি ব্যাংক। মামলায় তার স্ত্রী ও সন্তানকেও আসামি করা হয়। তার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬১ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন চলমান ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি বিবাদীদের পাসপোর্ট আদালতে জমা এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেয় অর্থ ঋণ আদালত, চট্টগ্রাম। কিন্তু এর আগেই মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী বিদেশে পালিয়ে যান। বাংলাদেশে থেকে যান ছেলে আলী ইমাম। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি আর বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেননি। অর্থ ঋণ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন মোহাম্মদ আলীর ছেলে আলী ইমাম। গত ৪ আগস্ট বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই রিট বাতিল করে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতের রায় বহাল রাখেন। রায়ে আদালত বলেন, ব্যাংক যে ঋণ প্রদান করে তা হলো জনগণের আমানতের টাকা। জনস্বার্থ রক্ষায় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে দেশের যেকোনো অর্থ ঋণ আদালত।
ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার গ্রাহক মো. মনির উদ্দিন। তার কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কিন্তু দীর্ঘদিন মনির উদ্দিন মামলায় হাজিরা না দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জমা দেয়া পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মো. মনির উদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী পৌরসভায়। বাবার নাম আলতাফ হোসেন এবং মায়ের নাম মরিয়ম নেসা। কানাডার পাসপোর্টধারী ও ঋণখেলাপি মো. মনির উদ্দিনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য গত ২৯ নভেম্বর পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি পাঠায় ব্যাংকটির মহাখালী শাখা। চিঠিতে বলা হয়, কানাডার পাসপোর্টধারী মনির উদ্দিন ইসলামী ব্যাংকের পুরোনো ঋণখেলাপি। তার বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা বিচারাধীন। তিনি যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, পাশাপাশি তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মনির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, ব্যাংকের কাছে জমা দেয়া যোগাযোগের ঠিকানা বা তথ্য সঠিক দেননি তিনি। তবে, তার ছোট ভাই রাসেলের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী অন্যতম। ২০টির বেশি মামলায় চট্টগ্রামের ইমাম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আলী ও সংশ্লিষ্টদের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে।
একই অভিযোগে পেনিনসুলা স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম, তার স্ত্রী রাশেদা জাফর, ছেলে জুনায়েদ আলম ও ভাই আবুল আলমের পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালত এ আদেশ দেন। আদালত সূত্রে জানা যায়, পেনিনসুলা স্টিলের কাছে ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের ২৩৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পাওনা। ঋণের বিপরীতে যে জামানত রয়েছে তা দিয়ে এ ঋণের সমন্বয় সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকের পক্ষ থেকে পেনিনসুলা স্টিলের এমডি জাফর আলম, তার ভাই আবুল আলম, স্ত্রী রাশেদা আলম ও ছেলে জুনায়েদ আলমের পাসপোর্ট জব্দের আবেদন করা হয়। ওয়ান ব্যাংক ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে পেনিনসুলা স্টিল। সব ব্যাংকই তাদের বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করেছে। এছাড়া, জনতা ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি আরএসআরএম গ্রুপের কাছে ১০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা আটকা আছে। ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আরএসআরএম গ্রুপের এমডি মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের লালদিঘী ইস্ট কর্পোরেট শাখা। এ গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা পাওনা তাদের। এর মধ্যে মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪০৯ কোটি, মেসার্স রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ৩০৫ কোটি ও এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ৫১২ কোটি টাকা পাওনা। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপিরা বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের মামলা ঝুলে আছে। পলাতক খেলাপিদের কাছ থেকে আইনগত প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায় না হওয়ায় নতুন করে বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা। ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বর্তমানে বেড়েছে।
ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, আদালতের নির্দেশনায় আরও এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসাবে দেখানো যাচ্ছে না। খেলাপিদের কেউ কেউ এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। কেউ আবার বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের অনেকেই আটকে আছেন ঋণ খেলাপির দায়ে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে। এই পরোয়ানা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের বিপুল অঙ্কের এই অর্থ রক্ষায় যেকোনো মূল্যে তাদের দেশত্যাগ বাধা দিতে হবে। অন্যদিকে, বিদেশে অবস্থানরত খেলাপিদের দেশে এনে অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাত বড় হয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে, সঙ্গে এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে। আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন অনেক ঋণখেলাপি। ফলে ব্যাংকের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়। খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যে ব্যবস্থা আছে তা দিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ, তারা বেশ শক্তিশালী। আমরা চাই, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক। যাতে তারা বিদেশে পালাতে না পারে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে একাধিকবার বসা হয়েছে। আমরা আদালতের সংখ্যা বাড়ানোসহ বিচার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলেছি। এ বিষয়ে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের প্রত্যাশা, যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ ঋণ-সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে অর্থ ঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি। এর বিপরীতে ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে অর্থ ঋণ আদালতে মামলার স্থিতি ছিল ৬৮ হাজার ২৭১টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে অর্থ ঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৯৮টি। একই সময়ে ব্যাংকের দাবি করা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে নয় হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।