ব্যাংকের অর্থ না দিয়ে দেউলিয়া হতে চান ব্যবসায়ীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪৩ পিএম, ১১ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:১৭ এএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
নানান ফন্দিফিকিরে ব্যাংকের অর্থ না দিয়ে দেউলিয়া হতে চান ব্যবসায়ীরা। তাদের বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এর দায় শুধু ঋণখেলাপিদের নয়, ব্যাংকেরও। যেমন একটি মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, বাদীগণ অর্থের অভাবে বর্তমানে একবেলা খান তো দু বেলা না খেয়ে থাকেন। আরেকটি মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, অর্থের অভাবে বাদীর ছেলেরা টিউশনি করে লেখাপড়া চালায়। ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে এভাবে নিজেদের ফতুর দেখিয়ে দেউলিয়া ঘোষণার প্রবণতা বাড়ছে ঋণখেলাপিদের মধ্যে। অথচ তাদের বেশিরভাগই দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিতেই এমন কৌশল নিচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। তারা ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি বছর অন্তত ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। এ তালিকায় প্রবাসী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাবেক চেম্বার সভাপতি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও রয়েছেন। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশের ১৮টি ব্যাংক, দুটি এনজিও ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ পাওনার বিপরীতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই গচ্ছিত তেমন কোনো সম্পদ নেই। ফলে পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে।
বিদ্যমান আইনে সাধারণভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বা অন্য কোনো কারণে কারও ঋণ পরিশোধের মতো সক্ষমতা না থাকলে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। তবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করা বেশিরভাগ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই প্রকৃত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নয় বলে জানা গেছে। তাছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে অর্থঋণ আদালতে মামলা চলমান থাকার পরও তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন।
দেউলিয়াবিষয়ক আদালতে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্লাসিক সাপ্লাইজ-১, ক্লাসিক সাপ্লাইজ-২ এবং কোমো অ্যাপারেলস। তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ও বেসরকারি খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাওনা ৩৩৫ কোটি ২৪ লাখ ৪৩ হাজার ১৭৩ টাকা। এসব দেনার বিপরীতে সোনালী বাংকে জামানত হিসেবে দেয়া আছে শুধু ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বরে ৫৭১ শতাংশ জমির ওপর একটি পুরাতন ৯ তলা জরাজীর্ণ ভবন। ব্যবসা গুটিয়ে প্রতিষ্ঠান তিনটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদ থাইল্যান্ডে আছেন বলে জানা গেছে। ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান তিনটির পরিচালক হলেনÑ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এইচ এম রায়হান শরীফ। ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত ঋণখেলাপির তালিকায় এ তিন প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল।
এ টাকা আদায়ের জন্য সোনালী ব্যাংক ঢাকার ১ নম্বর অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর আদালত রায় দেয়ার পর তারা টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য ২০২২ সালে এসে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে ঢাকার দেউলিয়াবিষয়ক আদালতে তিনটি মামলা করেন, যার মামলা নম্বর ০৫/২০২২, ০৬/২০২২ ও ০৬/২০২২।
দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করা বাকি ২২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৩৬ কোটি ৫৪ লাখ ৪ হাজার টাকা পাবে বিভিন্ন ব্যাংক। এসব দেনার বিপরীতে অধিকাংশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পদ নেই বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছেন।
এছাড়া দেউলিয়ার আবেদন করেছেন আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকার দেনাদার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ফুজিয়ান ইলেকট্রনিক্সের মালিক সৈয়দ তৌফিকুল হক ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম; অগ্রণী ব্যাংকের ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকার দেনাদার ঢাকার দারুসসালাম থানার ৫০ এস এ খালেক হাউজিংয়ের বাসিন্দা নেদারল্যান্ডসের নাগরিক এনামুল চৌধুরী; ইস্টার্ন ব্যাংক, আবুল খায়ের গ্রুপ, এনজিও ব্র্যাক ও সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিসের ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার দেনাদার দক্ষিণখানের ফরিদাবাদের ২৫ শুক্কুর আলী মসজিদ রোডের মেসার্স রাফি ট্রেডার্সের মালিক মো. মিজানুর রহমান; ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্সের ১ কোটি ২২ লাখ টাকার দেনাদার পল্টন থানাধীন ১৫/১৭ শান্তিনগর বাজার রোডের একেএম আজাদুল হক।
অন্য মামলাগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকার ওয়ারীর ১২ র্যাংকিং স্ট্রিটের মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার এবং দিনাজপুর চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সাবেক সভাপতি ছিলেন। ঢাকা ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকে মোট পাওনা ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৬২ হাজার ২৮৪ টাকা। রাজধানীর রমনা থানার ৫৭ রিজিয়া ভিলার বাসিন্দা মেহের নিগার রুনা সিটি হার্টে অবস্থিত মোবাইল সেন্টারের মালিক। বেসিক ও সোনালী ব্যাংকে তার দেনা ২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। মতিঝিলের ১৮, ৮৯ লাকি চেম্বারের ঠিকানার ইকেই টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হক ও তার স্ত্রী পরিচালক সামসুন নাহার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম। বেসিক ব্যাংক ও মেসার্স ডিএল এন্টারপ্রাইজ তাদের কাছে পাবে ১৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তাদের কোনো সম্পত্তি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঋণখেলাপিদের ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়ার এটাও একটা উপায়। কারণ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দিলে ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার প্রশ্ন থাকবে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা খেলাপি, তাদের বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এর দায় শুধু ঋণখেলাপিদের নয়, ব্যাংকেরও। কারণ ব্যাংকের পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা এবং যোগসাজশ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়া সম্ভব নয়।