আলিফের বন্ড : মিলছে না বিনিয়োগকারী, জেবিসির ওপর চাপ প্রভাবশালীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০৩ পিএম, ৬ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫৩ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বন্ড ছেড়ে ৩শ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন পেলেও সেই বন্ড কেনার বিনিয়োগকারী পাচ্ছে না পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এ পরিস্থিতিতে বন্ডে বিনিয়োগের জন্য প্রভাবশালীদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশনের (জেবিসি) ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও আলিফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, প্রভাবের কোনো বিষয় নেই। বিনিয়োগ প্রোডাক্টের মেরিটের ওপর নির্ভর করবে। যদি ওনারা পছন্দ করেন বিনিয়োগ করবেন, পছন্দ না করলে করবেন না।
জেবিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ৩শ কোটি টাকার বন্ডে বিনিয়োগের জন্য জেবিসিকে যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সিকিউরড ফ্লোটিং রেডেট সম্পূর্ণ কনভার্টেবল বন্ড’। কিন্তু বংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাদের অনুমোদনে ‘আনসিকিউরড ফ্লোটিং রেটেড সম্পূর্ণ কনভার্টেবল বন্ড’ উল্লেখ করে। এছাড়া আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রস্তাবে ক্রেডিট রেটিংয়ের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ‘এ’ এবং স্বল্প মেয়াদে ‘এসটি-২’। কিন্তু বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্দেশনায় বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র খ্যাতনামা ও বাংলাদেশে অনুমোদিত রেটিং সংস্থার ‘এএ’ অথবা সমমানের নিচে নয় এমন রেটিং বন্ডে বিনিয়োগ করা যাবে।
জীবন বিমা করপোরেশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের বন্ড ‘সিকিউরড ফ্লোটিং রেডেট’ নাকি ‘আনসিকিউরড ফ্লোটিং রেটেড’ সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। আবার আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী, ক্রেডিট রেটিং ‘এএ’ নিচে থাকা বন্ডে বিনিয়োগ করা যাবে না। যে কারণে আমরা আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না। কিন্তু এই বন্ডে বিনিয়োগের জন্য জীবন বিমা করপোরেশনের ওপর প্রভাবশালী একটি পক্ষ চাপ সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, জীবন বিমা করপোরেশনের টাকা সাধারণ বিমা গ্রাহকদের। আমরা চাইলেই বিমা গ্রাহকদের টাকা যে কোনোভাবে খরচ করতে পরি না। একটি জীবন বিমা কোম্পানি কোথায় এবং কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে তা আইন দিয়ে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বন্ডে বিনিয়োগের জন্য আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জীবন বিমা করপোরেশন থেকে। এজন্য প্রথমে কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা, ক্রেডিট রেটিং রিপোর্ট, আইনগত ও ট্যাক্স সংক্রান্ত বিষয় এবং কোম্পানি বা ইস্যুকারীর মৌলিক বিষয় সম্পর্কে মতামত নেয়ার জন্য শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু জীবন বিমা করপোরেশনের বোর্ডসভায় শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণের বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জীবন বিমা করপোরেশনের সক্ষমতা এবং আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ, কোম্পানির মৌলিক বিষয়, আইনগত ও ট্যাক্স সংক্রান্ত বিষয়, ক্রেডিট রেটিং রিপোর্ট ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ চেয়ে আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আলিফের বন্ডে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে জীবন বিমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আমার একার নয়। অনেকগুলো কমিটি আছে, স্কুটিং (যাচাই-বাছাই) হবে।
এদিকে গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত বিএসইসির কমিশন সভায় আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩শ কোটি টাকার ছয় বছর মেয়াদি বন্ড অনুমোদন দেয়া হয়। সে সময় বিএসইসি থেকে জানানো হয়, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩শ কোটি টাকা আনসিকিউরড, ফ্লোটিং রেট, কনভার্টেবল বন্ডের প্রস্তাব শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ব্যাংক, বিমা কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট ও উচ্চ সম্পদশালী একক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বন্ডটি ইস্যু করা হবে।
বন্ডটির প্রতি ইউনিটের অভিহিত মূল্য এক লাখ টাকা। এই বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ তুলে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির অংশীদারত্ব গ্রহণ করবে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। একই সঙ্গে ওই কোম্পানির ব্যাংক দায় পরিশোধ, কোম্পানির জন্য মেশিনারি ক্রয়, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ও বন্ড ইস্যু সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয় বহন করবে। বিএসইসি থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর এরই মধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় চলে গেলেও বন্ডটিতে বিনিয়োগের জন্য এখনো বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বন্ডটির ট্রাস্টির দায়িত্ব পাওয়া বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী মিন্টু বলেন, এখন পর্যন্ত বন্ডটির কোনো সাবস্ক্রিপশন হয়নি। সাবস্ক্রিপশন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাস্তবে এখন খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারী পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ করলে রিটার্নও ভালো আসবে না। জীবন বিমা করপোরেশনকে বন্ডটিতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে তারাও বন্ডটিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে একথা বলা হলে তিনি বলেন, এখন কেউ চাচ্ছে না বিনিয়োগ করতে। কারণ এখন একটা ঝুঁকি আছে। ঝুঁকির সময়ে তো কেউ বিনিয়োগ করবে না। আলিফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আজিমুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন বন্ডের অনুমোদন পাই সে সময় ক্রেডিট রেটিং ছিল ‘এ’। বর্তমানে আমাদের ক্রেডিট রেটিং ‘এএ’। যেটা আইডিআরএ’র রিকয়ারমেন্টে মধ্যে আছে। বন্ডে বিনিয়োগের বিষয়ে জীবন বিমা করপোরেশনের ওপর প্রভাবশালীদের দিয়ে চাপ দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রভাবশালী কাউকে দিয়ে আমরা জীবন বিমা করপোরেশনের ওপর চাপ দেইনি। আমি নিজেই জীবন বিমা করপোরেশনের বিনিয়োগের চার্জে যারা থাকেন তাদের প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের কাছে আমরা আমাদের প্রেজেন্টেশন সরবরাহ করছি। ‘প্রভাবের কোনো বিষয় নেই। বিনিয়োগ প্রোডাক্টের মেরিটের ওপর নির্ভর করবে। যদি ওনারা পছন্দ করেন বিনিয়োগ করবেন, পছন্দ না করলে করবেন না। কিন্তু আমাদের তো চেষ্টা করতেই হবে, যতটুকু কনভিন্স করতে পারি। যতগুলো বিমা কোম্পানি আছে, ব্যাংক আছে আমরা সবার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি। বন্ডের বিনিয়োগ না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই অর্থনীতিতে একটা স্লো ডাউন আছে। সেটা আমাদের এক্সপোর্ট ফিগারে প্রতীয়মান। সুতরাং, তার একটা প্রভাব তো আসবেই। কিন্তু বিনিয়োগকারী ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ অ্যাপ্রোসে যেতেই পারেন। সেখানে কেউ আমাদের নেগেটিভ কিছু বলেনি। আমরা আশাবাদী বন্ডের সম্পূর্ণ অংশ সাবস্ক্রিপশন হবে।