ভরা মৌসুমেও চড়া দাম শীতের সবজির : সাধারণের সাধ্যের বাইরে গরুর মাংস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:১৭ পিএম, ২৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:১৯ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে নাভিশ্বাস মানুষের। চাল, ডাল, ডিম, চিনি ও তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। শীতের সবজিতেও ফেরেনি স্বস্তি। শুধুমাত্র মুলা ও পেঁপের দাম কিছুটা কম। ভরা মৌসুম চললেও এই দুই পদের সবজি ছাড়া অন্য প্রায় সব সবজির দাম চড়া।
আজ শুক্রবার সকালে সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে শীতকালীন সবজির প্রচুর আমদানি রয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী দাম কমেনি। এ নিয়ে ক্রেতাদের অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যদিও দোকান ভাড়া, আমদানি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিকে দাম বাড়ার কারণ বলছেন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা।
বাজারে সবজির দাম জানতে চাইলে খিলগাঁও তালতলা সিটি করপোরেশনের কাঁচাবাজারের বিক্রেতা শফিক মিয়া বলেন, পেঁপে ৩০ আর মুলা ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। শীতকালীন অন্যান্য সবজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় কেনাবেচা চলছে। মৌসুমি সবজি ছাড়া অন্যান্য সবজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ওই বাজারের অন্যান্য দোকান এবং আরও দুটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। ভরা মৌসুমেও কোনো বাজারে নাগালে নেই সবজির দাম। আবার নতুন করে বাজারে আসায় অনেক সবজির কেজি ১০০ বা তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বেশি দামে প্রয়োজনীয় সবজি কেনার সাধ্য হচ্ছে না অনেকেরই। সেগুনবাগিচা বাজারে গিয়ে কথা হয় নির্মাণশ্রমিক আজিজ মিয়ার সঙ্গে।
এই ক্রেতা বলেন, কয়েকজন মিলে এখানে একটি ভবনে থাকছি। নির্মাণকাজ চলছে। অতিরিক্ত দামের কারণে মাছ-মাংস তো কেনাই দায়। শীতকালীন নানা পদের সবজি খাবো, সে অবস্থাও নেই। শুধু মুলা আর পেঁপে খেয়ে চলছে। এদিকে সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম না কমার কারণ জানতে চাইলে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা মোকাম বা স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দিচ্ছেন। সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধিকেও সামনে আনা হচ্ছে।
সকালে একাধিখ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতকালীন অধিকাংশ সবজি ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শিম, পটলের তুলনায় অন্য সবজির দাম বেশি। একটি বড় সাইজের ফুলকপি ৪০-৫০ টাকা, বাঁধাকপি ও চালকুমড়াও বিক্রি হচ্ছে একই দামে। অন্যদিকে বরবটি, করলা, বেগুন, কচুর্মুখী, কাকরোল, ঝিঙে, চিচিঙ্গার কেজি বাজারভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাকা বা আমদানি টমেটোর কেজি ১১০ থেকে ১২০, গাজর ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি। এমন অস্বস্তি নিয়ে সবজির বাজার থেকে বেরিয়ে মুদি বাজারে গিয়েও কোনো সুখবর মিলছে না ক্রেতার। বরং বাজারে আরেক দফা বেড়েছে চাল, তেল, আটা, ময়দা ও চিনির দাম। এতে সাধারণ মানুষ আরও বিপাকে পড়েছেন।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে মোটা চালের দাম না বাড়লেও বেড়েছে চিকন চালের দাম। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবি চিকন চালের কেজি ৩ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৭২ টাকা, মাঝারি বা পাইজাম চাল ২ টাকা বেড়ে ৫৪ থেকে ৬০ টাকা এবং মোটা চালের কেজিতে ২ টাকা বাড়িয়ে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
যদিও বাজারের খুচরা ব্যবাসয়ীরা বলছে, টিসিবির তথ্যের থেকে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্যাকেটজাত আটা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট ময়দায় ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে গত ১৭ নভেম্বর থেকে সয়াবিন তেল ও চিনির দাম আরও বেড়েছে। এখন সয়াবিন তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। আগের চেয়ে কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১২ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হয়েছে ১০৭ টাকায়। যদিও বাজারে নির্ধারিত দামের তেল পাওয়া গেলেও চিনি কিনতে ক্রেতাদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। সরবরাহ সংকটের কারণে বাজারভেদে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।
রাজধানীর খিলগাঁও বাজারে অনেক বছর ধরে গরুর মাংস বিক্রি করেন আনোয়ার হোসেন। ইদানীং তার ব্যবসা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। গরুর মাংসের দাম বাড়তি থাকায় আগের মতো আর বিক্রি নেই তার দোকানে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, মানুষ সচরাচর আর গরুর মাংস কিনছে না। সাধারণ ক্রেতারা খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ গরুর মাংস কিনে খায় না। বাসায় আত্মীয়-স্বজন আসা ছাড়া বা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া শখ করে কেউ খাওয়ার জন্য গরুর মাংস কেনে না। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতোই বাড়তি দামে গরু, খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে বাজারে। গরুর মাংস ৭০০ টাকায় আবার কোন কোন দোকানে ৬৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খাসির মাংস ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
মাংস বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, একটা গরুর কেনা দাম অনেক বেশি, সঙ্গে বিভিন্ন চাঁদা, দোকান খরচ, কর্মচারীর বেতন সব মিলিয়ে ৭০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করলেও লাভ করা যায় না। এর চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, এই দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। অনেকে মাংস বিক্রির ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছে। কিন্তু যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী তারা এই ব্যবসা ছাড়তে পারছেন না, চালিয়ে নিতেও পারছেন না। কারণ, ক্রেতা আগের চেয়ে অনেক কম। খুব প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ ক্রেতারা গরুর মাংস কিনছেন না।
রাজধানীর মহাখালী বাজারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাজার করতে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মেহেদি হাসান বলেন, দাম খুব বেশি থাকার কারণে সাধারণত গরুর মাংস কেনা হয় না। অনেকে আছে শখ করেও গরুর মাংস কিনতে পারে না। বাসায় যদি কোনো আত্মীয়স্বজন আসে সেক্ষেত্রে আমরা বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে গরুর মাংস কিনি। এছাড়া স্বাভাবিকভাবে মাসে একবারও গরুর মাংস কিনে খাওয়ার মতো অবস্থা সাধারণ মানুষের নেই। এত দাম দিয়ে কি মাংস কিনে খাওয়া যায়? অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়, সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাল কক মুরগিও বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়, এছাড়া লাল ডিম প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। মাংসের পাশাপাশি মাছের দামও উর্ধ্বমুখি। বাজারে তেলাপিয়া মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়, রুই মাছ ২৮০ থেকে ৩২০টাকায়, পাবদা মাছ আকার ভেদে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, চাষের কই ২৪০ টাকায়, পাঙাশ মাছ ২০০ টাকায়, সিলভার কার্প মাছ ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়, শিং ছোট সাইজের মাছ ৪০০ টাকায়, ট্যাংড়া মাঝারি ৬০০ টাকায়, ছোট চিংড়ি ৫০০ টাকা, মাঝারি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া টাকি মাছ ৪০০ টাকায়, আইড় মাছ ৮০০ টাকায়, রূপচাঁদা মাঝারিটা ৭০০ টাকায়, কাতল মাছ ৩০০ থেকে আকার ভেদে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর গুলশান লেক সংলগ্ন বাজারে আসা ক্রেতা ফিরোজুল ইসলাম বলেন, বাজারে আর কম দামের কোনো মাছ পাওয়া যায় না। এখন সব মাছের দাম বাড়তি। বাজারে এসে খুঁজে দেখি কোন মাছের দাম কম, এরপর সেই মাছ অল্প করে কিনে নিয়ে যাই। ভালো কোনো মাছ তো আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতারা আর কিনতে পারে না। বাজার খুঁজে সবচেয়ে কম দামের মাছ বলতে ২০০ টাকায় পাঙাশ আর তেলাপিয়া, এছাড়া ২৪০/২৫০ টাকায় চাষের কই পাওয়া যায়। এসব মাছ ছাড়া অন্য সব ধরনের মাছের দাম বাড়তি যা কেনা সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়।
মাছের দাম বেড়েছে এ কথা স্বীকার করে একই বাজারের মাছ ব্যবসায়ী ইব্রাহিম খলিল বলেন, মাছের খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণেই বাজারে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে আগের চেয়ে মাছ পরিবহন করে আনার খরচও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে বাজারে মাছের দাম বেড়েছে।