ডলার সংকটে এলসি বন্ধ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪১ পিএম, ১৫ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫৩ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
দেশে ব্যাপক হারে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চাপে পড়েছে দেশের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি। আর এ অবস্থার কারণে দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ডলারের দাম যেমনই হোক, সংকট দেখা দিচ্ছে চরম আকারে। এমন সময়েও আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি মূল্যে কিনতে হচ্ছে ডলার। এতে একদিকে আগের খোলা এলসির (ঋণপত্র) দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো, অন্যদিকে নতুন এলসি খুলতেও নানামুখী জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৫ অক্টোবরের তথ্যে এসব দেখা গেছে। অনেক ব্যাংক খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলাও বন্ধ রেখেছে। যে কয়েকটি ব্যাংকের কাছে এখনো ডলার আছে, সেগুলোও কমে আসছে। আর এই সংকটের কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার।
রাজশাহী : রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যাংকগুলোতে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানিতে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা। আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের অভাবে অনেকে লেটার অব ক্রেডিট বা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। এখন ভারত থেকে যেসব পণ্য আসছে তা অন্তত মাসখানেক আগে খোলা এলসির মাধ্যমে। নতুন করে এলসি খোলা যাচ্ছে না বলে মাসখানেক পর আমদানি অনেক কমে যাবে।
পণ্য আমদানিকারক মো. মিজান গত মাস থেকে ঘুরছেন অগ্রণী ব্যাংক রাজশাহী শাখাতে। ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের কাগজই সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে গত এক মাস ধরে কোনো ধরনের এলসি করতে পারেননি তিনি। আর ব্যবসা করতে না পেরে ব্যাংকে সুদ বাড়ছে তার। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। এতে করে বিপাকে পড়ছেন তিনি। মিজানের দাবি, শুধু তিনি একাই নন। তার মতো আরও বহু ব্যবসায়ীই এলসি খোলার জন্য এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ব্যাংকে গিয়ে শুনছেন ডলার নেই। ডলার সংকটে চাহিদামতো এলসি খুলতে না পেরে বিপাকে পড়ছেন আমদানিকারকরা। সংকট দ্রুত না কাটলে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা চরম বেকায়দায় পড়বেন। তবে এলসি খোলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের এক আমদানিকারক বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ কারণে ভারত থেকে আমরা কোনো পণ্যই আমদানি করতে পারছি না। এতে আমরা বেশ সমস্যায় পড়েছি। একরকম বেকার হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে ঋণের বোঝা। দ্রুত এলসি খোলার সুযোগ না এলে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা পথে বসবে।
এদিকে, স্বাভাবিক আমদানি-রফতানি থাকলে সরগরম থাকে সোনামসজিদ স্থলবন্দর বাজার। কিন্তু এখন পুরো বাজারে মানুষের সমাগম অনেকটাই কমে গেছে। আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, কাজ নেই। এ কারণে জিরো পয়েন্ট (বন্দর বাজার) যাওয়াই হয় না। বাড়িতে বসে বা আশপাশে ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছেন তারা।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনার প্রভাত কুমার সিংহ জানান, এলসি নিয়ে জটিলতার কথা আমার জেনেছি। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছেন না। তবে এর প্রভাব এখনই খুব প্রকটভাবে বোঝা যাবে না। কারণ এলসি করার বেশ কিছুদিন পরে মূলত মালামাল আসে। এখন যেসব মালামাল আসছে সেগুলো আগের এলসি করা। এই প্রভাবটা হয়তো আরও ১০ থেকে ১৫ দিন পরে বোঝা যাবে। এই স্থলবন্দর দিয়ে বেশি আমদানি হয় পাথর এবং পেঁয়াজ। এছাড়া ফল, ভুট্টা, ভুসি ও মসলা আসে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, রাজশাহীর কোনো ব্যাংকেই ডলার নেই। তারা সব ডলার এখন ঢাকায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের এলসি খোলা বন্ধ। ব্যবসায়ীরা পড়ছেন লোকসানে। চেম্বার সভাপতি বলেন, আমরা ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে চলতি মাসের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দিয়েছি। ব্যবসায়ীরা চান অতি দ্রুত এলসি খোলা শুরু হোক।
যশোর : যশোরের ব্যাংকগুলো আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন জেলার আমদানিকারকরা। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা পণ্যের দায় পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। এজন্য নতুন এলসি খোলা বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলসি খোলা বন্ধ থাকলে চরম সংকটের সম্মুখীন হবেন ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে পণ্যের দামও বাড়বে। সংকটের কারণে যথাসময়ে ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব ব্যাংকে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী ধারার ইসলামী ব্যাংকটির ডলার ধারণক্ষমতা ৫৩ মিলিয়ন হলেও এ মুহূর্তে উদ্বৃত্ত কোনো ডলার নেই। উল্টো ৮৮ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে। সারা দেশের মতো যশোর শাখায়ও কোনো ডলার নেই তাদের। অগ্রণী, ইসলামী কিংবা এক্সিম ব্যাংকের মতো পরিস্থিতি এখন বেশির ভাগ ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডলার ঘাটতিতে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক ৮৮ মিলিয়ন, ঢাকা ব্যাংক ৬৮, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৬৪, ইউসিবিএল ৪৯, দ্য সিটি ব্যাংক ৪৭, পূবালী ব্যাংক ৪৫, প্রাইম ব্যাংক ৪২ ও সাউথইস্ট ব্যাংক ৪১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৩৫ মিলিয়ন ডলার। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩৪, ওয়ান ব্যাংক ৩২, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২৭, ন্যাশনাল ব্যাংক ২৪, ব্যাংক এশিয়া ১৪ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ১১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ৮ মিলিয়ন ডলার করে ঘাটতিতে রয়েছে ট্রাস্ট, ব্র্যাক ও এনসিসি ব্যাংক। বিদেশি খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনেও ৪ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে।
হিলি স্থলবন্দরে এলসি বন্ধ : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার হিলি স্থলবন্দরে এলসি বন্ধ রয়েছে। এতে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বিপাকে পড়ছেন বন্দরের আমদানিকারকরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ হারুন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা স্থানীয় ব্যাংকের নির্দেশে আমদানিকারকদের এলসি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ব্যাংক এলসিতে নিরুৎসাহিত করছেন, আবার অনেক ব্যাংক একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে আমদানিকারকরা বিপাকে পড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেক পণ্য আমদানিতে চুক্তি করে রেখেছেন এদেশের ব্যবসায়ীরা। এলসি না করতে পারায় ওইসব পণ্য আমদানি করতে পারছেন আমদানিকারকরা। এতে ওই দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেকটা মনোমালিন্য হচ্ছে। দীর্ঘ দিন যদি এভাবে এলসি বন্ধ থাকে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি না হলে, দেশের বাজারে মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শর্তসাপেক্ষেও যেন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে অনুমতি দেন।
হিলি শাখার অগ্রণী ব্যাংকের এজিএম মশিউর রহমান বলেন, এলসি বন্ধ করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় এলসি করতে আমদানিকারকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের খুলনা জোনের প্রধান আবু সাইদ আবদুল মান্নাফ জানান, বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দেশে ডলার সংকট চলছে। আমদানি করা পণ্যের দায় পরিশোধ করতে না পারায় নতুন করে এলসি খোলা বন্ধ করা হয়েছে। পরিস্থিতি ভালো হলে আবারও খোলা হবে। ইস্টার্ন ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল হক জানান, বেশির ভাগ ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে এলসি নেয়া বন্ধ করেছে। এতে আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা পণ্য আনতে না পারলে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তখন ব্যাংকও সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। কেননা ব্যবসা করতে না পারলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কামাল আজাদ বলেন, কমার্শিয়াল এলসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিষেধ নেই। প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে এলসি ওপেন করবে। সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি মোতাবেক তদারকি করবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি, সার ও খাদ্যের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে আসছে এবং দিয়ে যাবে।