বাজারে মোটা চালের ‘কৃত্রিম’ সংকট, অসহায় নিম্নবিত্ত মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪০ পিএম, ৯ নভেম্বর,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:৫৭ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
অধিকাংশ দোকানে টাকা দিয়েও মিলছে না মোটা চাল। হু হু করে বাড়ছে দাম। মহল্লার দোকানে মোটা চাল একেবারেই অপ্রতুল। চালের আড়ত কিংবা বড় বাজারেও সাত দোকান ঘুরে মিলছে এক দোকানে। এতে চরম বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাধ্য হয়ে তারা বেশি দামে মাঝারি মানের চাল কিনছেন পেটের তাগিদে। আড়তদাররা বলছেন, মিলাররা মোটা চাল সরবরাহ করছেন না। যাদের কাছে মিলছে দাম হাঁকছেন বেশি। আর অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আঙুল মজুতদারদের দিকে। এ সংকট কৃত্রিম হতে পারে বলে ধারণা তাদের। মহাখালীর সাততলা বস্তির একটি টিনশেড ঘরে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন আনোয়ার হোসেন। পেশায় রিকশাচালক। আমতলী বাজারে চাল কিনতে যান আনোয়ার। চার-পাঁচটি দোকান ঘুরে কোথাও মোটা চাল পাচ্ছিলেন না। পরে একটি দোকানে মোটা চাল পান। ৫৬ টাকা দরে কেনেন পাঁচ কেজি।
আলাপকালে আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে যে কোনো মুদি দোকানে মোটা চাল পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে মুদি দোকানে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজারে গিয়েও চালের বড় দোকান বা আড়তে মোটা চাল মেলে না, যা পাওয়া যায়, দাম বেশি রাখে। আবার বেশি দামের কারণে মাঝারি বা সরু চালে তো হাতই দেয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে নিম্নআয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমতলী বাজারে বড় সাতটি মুদি দোকানে চাল বিক্রি হয়। এর মধ্যে পাঁচটি দোকানেই মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না, ইরি) দেখা যায়নি। দোকানিদের দাবি, বাজারে মোটা চালের সরবরাহ কম। তাই সংকট তৈরি হয়েছে। এতে অনেক দোকানি বাধ্য হয়ে কেজিতে দু-এক টাকা বাড়িয়ে চাল বিক্রি করছেন। নিরুপায় হয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ চাল কিনছে। তবে মাঝারি ও সরু চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। মিলারদের কারসাজিতে বাজারে মোটা চালের সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন আমতলী বাজারের মতিউর রাইস এজেন্সির মালিক মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে বাজারে চালের সংকট তৈরি করেন মিলাররা। এখন মাঝারি ও সরু চাল বাজারে পাওয়া গেলেও মোটা চালের সংকট রয়েছে। রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোটা চাল নেই বললেই চলে। কিছু দোকানে মিললেও প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়। অথচ কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যমতে, ৩ নভেম্বর ঢাকার বাজারদরে মোটা চাল পাইকারি ৪৩-৪৪ টাকা এবং খুচরায় ৪৭ থেকে ৫০ টাকা।
ঢাকার মধ্যে কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার, নয়াবাজার, বাবুবাজার, শ্যামবাজারে কয়েক হাজার পাইকারি ও খুচরা চালের আড়ত বা দোকান রয়েছে। সম্প্রতি এই বাজারগুলোতেও মোটা চালের সংকট দেখা গেছে। বাধ্য হয়ে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ মাঝারি ও সরু চাল কিনছেন। চকবাজারের উর্দু রোডের প্রবীণ বাসিন্দা হাসান উদ্দিন। গত বুধবার (২ নভেম্বর) বিকেলে মোটা চাল কিনতে মৌলভীবাজারে যান। কিন্তু অনেক ঘোরার পর একটি দোকানে পান মোটা চাল। ৫৫ টাকা দরে ১০ কেজি চাল কেনেন।
ফেরার পথে আলাপকালে হাসান উদ্দিন বলেন, আগে মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে চাইলেই মোটা চাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বলে বাজারে মোটা চাল নেই। আবার মাঝারি বা সরু চাল কিনে খাওয়ার মতো সাধ্যও নেই। তাই মৌলভীবাজারে চাল কিনতে এসেছি। অনেক খুঁজে একটি দোকানে পেলাম। বাজারে মোটা চাল কেন পাওয়া যাচ্ছে না, এ উত্তর কেউ দিতে পারেননি।
মৌলভীবাজারের বিক্রমপুর রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী নবীর হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের বাজারে চাল সরবরাহ করেন মিলাররা। তাদের কাছে মোটা চাল চাইলে বলে, চাল নেই। তারা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়া ও চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম থাকায় মিলে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অথচ বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে বাজারে মোটা চালের প্রচুর চাহিদা। প্রতিদিন শত শত মানুষ মোটা চাল কিনতে গিয়ে ফেরত যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, গত আমন, বোরো, ইরি মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু তারপরও বাজারে চালের সংকট। মাঝারি ও সরু চাল বেশি দামে কিনতে গিয়ে কর্মহীন, নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট থেকে ১০ কেজি মাঝারি চাল (পাইজাম) কেনেন মাসুদ রানা। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন বাবর রোডে। আলাপকালে বলেন, দিন যত যাচ্ছে, সংসারে ব্যয় তত বাড়ছে। আর এই ব্যয়ের বড় একটি খাত চাল। তারপরও বাজারে মোটা চাল পাওয়া যায় না। পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে ঢাকার অধিকাংশ মুদি দোকানি চাল কেনেন। সরেজমিনে দেখা যায়, এই বাজারের প্রতিটি দোকানেই কৃষি বিপণন অধিদফতর নির্ধারিত চালের দাম উল্লেখ করে বোর্ড টাঙানো। সেখানে মোটা চালের দাম লেখা আছে ৪৪ টাকা কেজি। তবে অধিকাংশ দোকানে মোটা চাল দেখা যায়নি। এছাড়া নয়াবাজারের খুচরা পর্যায়ের ১৫টি দোকানের মধ্যে মোটা চাল পাওয়া গেছে দুটি দোকানে।
ওয়ারীর নারিন্দার মুদি দোকানি কামাল হোসেন। দিনে তার দোকানে তিন বস্তা চাল বিক্রি হয়। এর মধ্যে মোটা চালের চাহিদা বেশি বলে জানান তিনি।
কামাল হোসেন বলেন, ক্রেতাদের চাহিদা থাকলেও গত এক-দুই মাস ধরে আড়তে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দুই-চার বস্তা মোটা চাল পেলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অনেক দরিদ্র মানুষ বাধ্য হয়ে মাঝারি বা সরু চাল কিনছেন। নয়াবাজার-বাবুবাজার এলাকা থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্যানে চাল নিয়ে যান চালক মোতালেব। আলাপকালে জানান, তিনি চকবাজারের শহীদ নগরে একটা রিকশার গ্যারেজে মেস করে থাকেন। ওই মেসে আগে একবেলা ভাত খেলে ৪০ টাকা দিতে হতো। এখন মোটা চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় প্রতিবেলা ৬০ টাকা দিতে হয়।
বাবুবাজারের দৌলত ভান্ডারের ক্যাশিয়ার মো. তাহের আলী বলেন, বর্তমানে মার্কেটে মোটা চাল নেই বললেই চলে। আগে মোটা যে চালের কেজি ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা তা বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আল হেলাল রাইস এজেন্সির চাল বিক্রেতা আলী আজম বলেন, আগে আমাদের দোকানে চালের স্টকে ২০০ থেকে ৩০০ বস্তা চাল মজুত থাকতো। বর্তমানে দু-তিনটি মোটা চালের বস্তা রয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে চালের কেজিতে এক থেকে দুই টাকা আরও বাড়তে পারে। বাবুবাজার সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাদামতলী চালের আড়ত। সেখানে মোট ২৭টি আড়তের মধ্যে মোটা চাল ছিল ৯টি আড়তে। জানতে চাইলে নুরুদ্দিন রাইস এজেন্সির মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বাজারে মোটা চালের সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা চাইলেও মোটা চাল সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করছেন মিলাররা। এই সংকট কবে কাটবে জানা নেই। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম বলেন, ঠিক কী কারণে খোলাবাজারে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না, তা জানা নেই। তবে ধারণা করছি, দাম বাড়াতে বড় ব্যবসায়ীরা মোটা চাল মজুত করেছেন। সরকারের গোয়েন্দারা তদন্ত করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, দেশের কৃষক ও মিল মালিকরা ধান-চালের পর্যাপ্ত মূল্য পায় না। এর মধ্যে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে চাল আমদানি করার। এখন চালও যদি আমদানি করতে হয় তাহলে ডলার বিদেশে চলে যাবে। এটি না করে মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারের বসা উচিত। এই সংকট সমাধানে পথ খুঁজে বের করা দরকার।