কারখানা বন্ধের শঙ্কা : প্রয়োজনে আমদানি করে এলএনজি সরবরাহ চান ব্যবসায়ীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:০৮ পিএম, ২৫ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১০:১৯ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
গ্যাসের সংকটে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকছে শিল্পকারখানা। এতে কমছে উৎপাদন, বাড়ছে খরচ। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহ কমার পাশাপাশি রফতানি পণ্যের ক্রয়াদেশও কমে যাচ্ছে। অনেক কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কেউ লোকসান দিয়ে কোনোমতে টিকে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে শিল্পকারখানায় সরবরাহ করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, সেটা না হলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। অন্যদিকে কোনো কোনো ব্যবসায়ী সংগঠন সরকারের পক্ষ থেকে আশার আলো না পেয়ে সিএনজি সিলিন্ডারে করে গ্যাস কিনে কারখানা চালু রাখতে চাচ্ছেন। সেজন্য এরই মধ্যে প্রস্তাবও করা হয়েছে। তবে সে প্রক্রিয়ার কোনো অনুমোদন নেই সরকারের। এছাড়া দুর্ঘটনারও ঝুঁকি রয়েছে। এরপরও যে কোনো মূল্যে গ্যাস চান ব্যবসায়ীরা। এদিকে গ্যাসের কারণে চিনির বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, গ্যাসের কারণে চিনি নিয়ে এ সংকট। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত র-সুগার (অপরিশোধিত চিনি) আছে। সেটা পরিশোধনে আমাদের স্টিম চালাতে হয়, সেজন্য যে পরিমাণ গ্যাসের চাপ দরকার সেটা পাচ্ছি না। আমাদের দৈনিক চিনির উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার টন, সেখানে রবিবার পেয়েছি এক হাজার ৪০০ টন। আগের দিনে পেয়েছি ১৩ হাজার। মেঘনা গ্রুপের কারখানাসহ সবারই একই অবস্থা। শুধু চিনি নয়, গ্যাস সংকটে বস্ত্র খাতের ৯০ শতাংশ কারখানাই এখন ভুগছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় কারখানাগুলো দিনে প্রায় ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যে কারণে এ খাতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
জানা যায়, প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে এক ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে এ খরচ বেড়ে আড়াই ডলারে পৌঁছেছে। গত আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। বস্ত্রকলের পাশাপাশি ওই এলাকা ঘিরে রয়েছে অন্যান্য শিল্পগুলোও। এ বিষয়ে রবিবার (২৩ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করেছে বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, দ্রুত সমস্যার সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারাবেন। দেশের ব্যাংকগুলোও পুঁজি হারাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পেলে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ছয় টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ দিতে বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা রাজি। তারপরেও সরকারের কাছে আমরা গ্যাস চাই।
জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্পকারখানাসহ দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দেশে মোট গ্যাসের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে, ১৮ শতাংশ শিল্পে, ক্যাপটিভ খাতে ১৬ শতাংশ ও সার উৎপাদনে ৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। কয়েক মাস আগেও আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ (এলএনজি) পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারতো ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৬০ কোটি ঘনফুটের কিছুটা বেশি। সাড়ে তিন মাস ধরে চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে পেট্রোবাংলা। তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আসছে। এদিকে রবিবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে শিল্পখাতে জ্বালানি সংকটের প্রভাব হ্রাস নিয়ে একটি আলোচনা সভা করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। ওই সভাতেই ব্যবসায়ীরা গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট নিয়ে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। তবে সেখানে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আভাস দিতে পারেননি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী। উল্টো তিনি বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্তে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আগামী ছয় মাসে রিজার্ভ বাড়ারও সম্ভাবনা নেই।
এরপর বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে যে সংকট চলছে, তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে মন্দা শুরু হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, সাহস নিয়ে ব্যবসায়ীরা শিল্পখাতে অনেক বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংকগুলোও সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের কারণে সবার ডোবার মতো অবস্থা হয়েছে। এদিকে, দেশের বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস পোশাকখাতে গত তিন মাসে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। এছাড়া বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানায় নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ।
সংগঠনটির সহ-সভাপতি আক্তার হোসেন বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে এরই মধ্যে নেতিবাচক বার্তা চলে গেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে ক্রেতারা চলে যাওয়ার পর এখনো সেখানে ফেরেননি। সংকট না কাটলে বাংলাদেশের বেলায়ও এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু রাখতে নানা উপায় খুঁজছেন দেশের শিল্পমালিকরা। তিন গুণ বেশি দামে তারা সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে করে গ্যাস নিতে চাচ্ছে। তবে সরকারের অনুমতি ছাড়া এভাবে গ্যাস দিতে রাজি হচ্ছেন না সিএনজি স্টেশনের মালিকেরা। সেজন্য অনুমতি চেয়ে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছে সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন।
জানা গেছে, কয়েকদিন আগে সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছে সিলিন্ডার করে গ্যাস নিতে তাদের অনুরোধ করে তৈরি পোশাকখাতের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও সিরামিক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) চিঠি দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিসিএমইএর সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, গত ছয় মাস গ্যাসের সমস্যা। এখন সেটা প্রকট। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ থেকে কারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রফতানি ও স্থানীয় বাজারে পণ্য দেয়া যাচ্ছে না। বারবার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আমাদের টিকে থাকতে যে কোনো মূল্যে গ্যাস প্রয়োজন। যদিও এ বিষয়টি সরকারের অনুমোদিত কোনো উপায় নয় বলে জানিয়েছে সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর।
তিনি বলেন, সিলিন্ডারে করে গ্যাস দেয়ার অনুমোদন নেই। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু শিল্পের জন্য দুটি সংগঠন গ্যাস চাচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আমাদের করণীয় জানতে পেট্রোবাংলার কাছে চিঠি দিয়েছি।