লিজিংয়ের শেয়ার ছাড়ছে বিদেশিরা, কিনছে প্রতিষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৭ পিএম, ২০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। এরমধ্যে নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে লেনদেনই হয় না। নিয়মিত শেয়ার লেনদেন হওয়া বাকি ২২টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৯টিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আছে। যদিও এ বিনিয়োগের পরিমাণ বেশ কম। আর বাকি ১৩টি কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই নেই। এ পরিস্থিতিতেও গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অবশ্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করলেও এ কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ নিয়ে কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বে-লিজিং, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স (ডিবিএইচ), আইডিএলসি ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের শেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে। এরমধ্যে সেপ্টেম্বরে বে-লিজিং, ডিবিএইচ এবং আইডিএলসি ফাইন্যান্সের বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। অবশ্য বিদেশিরা বিক্রি করলেও এ সময়ে নতুন করে এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এরমধ্যে বে-লিজিংয়ের যে পরিমাণ শেয়ার বিদেশিরা বিক্রি করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি শেয়ার প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান। এ অবস্থায় লোকসানের ঝুঁকি এড়াতেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। বিশ্বমন্দার আশঙ্কা এবং টাকার মান কমে যাওয়ায় শুধু লিজিং কোম্পানি নয়, শেয়ারবাজারের বিভিন্ন খাতের ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারও ছেড়ে দিচ্ছেন বিদেশিরা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে বিদেশিদের সব থেকে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ডিবিএইচয়ের শেয়ারে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। এক মাস আগে অর্থাৎ আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটির দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করলেও কোম্পানিটির শেয়ার সেপ্টেম্বর মাসে নতুন করে কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আগস্ট শেষে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার ছিলো। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটির দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে কিনেছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রি করার তালিকায় থাকা আর এক প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং। আগস্টে এ কোম্পানিটির দশমিক ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের হাতে। সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে দশমিক শূন্য ১ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ কোম্পানিটির দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। অন্যদিকে আগস্ট শেষে কোম্পানিটির ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ শেয়ার ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। অর্থাৎ এক মাসে কোম্পানিটির দশমিক ৫৯ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার পরিমাণ চারগুণের বেশি। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে। বিদেশিরা কোম্পানিটির বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে কিনেছেন। সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির শেয়ার আছে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এক মাস আগে আগস্টে যা ছিলো ২ দশমিক ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে বিদেশিরা কোম্পানিটির ১ দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। বিপরীতে আগস্ট শেষে কোম্পানিটির ২৬ দশমিক ৬২ শতাংশ শেয়ার ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটির দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। লিজিংয়ের তিন কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়ার মধ্যেই এ খাতের তিন কোম্পানিতে নতুন করে কিছুটা বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন বিদেশিরা। এরমধ্যে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছেন বিদেশিরা। আগস্টে কোম্পানিটির দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার ছিলো বিদেশিদের কাছে, সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছে। বিদেশিরা নতুন করে কিনলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করেছেন। আগস্টে কোম্পানিটির ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে ২২ দশমিক ৫১ শতাংশে নেমেছে। বিদেশিদের শেয়ার কেনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বেচার ঘটনা ঘটেছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়েও। আগস্টে কোম্পানিটির কোনো শেয়ার বিদেশিদের কাছে ছিল না। সেপ্টেম্বরে দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন বিদেশিরা। অন্যদিকে আগস্টে কোম্পানিটির ২৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, সেপেটম্বর শেষে তা কমে ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়া আর এক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স। সেপ্টেম্বরে এ কোম্পানিটিরও দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন বিদেশিরা। আগস্টে দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ শেয়ার ছিলো বিদেশিদের কাছে, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ হয়েছে। বিদেশিদের পাশাপাশি কোম্পানিটির শেয়ার নতুন করে কিনছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও। আগস্টে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ শেয়ার ছিলো, সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছে। বিদেশিদের বিনিয়োগ থাকা বাকি তিন কোম্পানিতে বিনিয়োগ অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে মাইডাস ফাইন্যান্সের দশমিক ৪২ শতাংশ, প্রাইম ফাইন্যান্সের দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। বিদেশিদের শেয়ার ধারণের চিত্রে পরিবর্তন না এলেও মাইডাস ফাইন্যান্সের শেয়ার নতুন করে কিনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আগস্টে কোম্পানিটির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে ২৬ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে প্রাইম ফাইন্যান্স এবং উত্তরা ফাইন্যান্সে শেয়ার বিক্রি করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এরমধ্যে আগস্টে প্রাইম ফাইন্যান্সের ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে নেমেছে। আর উত্তরা ফাইন্যান্সে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ ৩২ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে কমে ৩২ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়েছে।
বিদেশিদের লিজিং কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগামী বছর বিশ্বমন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমার ধারণা, এ কারণেই বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন। এছাড়া কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো করলেও সার্বিকভাবে আমাদের আর্থিক খাত খুব একটা ভালো অবস্থা নেই। খেলাপি বাড়াসহ এ খাতে রয়েছে নানা অনিয়ম। শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শুধু লিজিং কোম্পানি নয়, বিদেশিরা গত ছয় মাসে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছেন। এর মূল কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া। বিদেশিরা সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তারা এখন বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যেখানে ডলারে বিনিয়োগ করা যায়, সেদিকে ঝুঁকছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছেন। তবে টাকার মান কমে যাওয়া এবং বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় হয়তো শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।