ঋণ খেলাপির চাপে দুর্দশায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪১ পিএম, ৩০ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৫৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
নানা অব্যবস্থাপনায় বেহাল দশায় চলছে দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে সরাসরি উদ্যোক্তা-পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে বিতরণ করা ঋণের অর্থ ফেরত আসছে না। মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ কারণে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে তারল্য সংকটে পড়ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। দুর্দশায় পড়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ এবং এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিক মার্চে এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। ছয় মাসে বেড়েছে দুই হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ। এরও আগে অর্থাৎ ২০১৯ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ছয় হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৯ শতাংশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ খেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব নীতিমালা করেছে তাতে ঋণ খেলাপিরা অনেক ছাড় পেয়েছে। তার মনে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুবিধা দিচ্ছে। এর ফলে খেলাপিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে ভালো গ্রাহকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়া কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। তাদের কাজ বা নীতিগুলো হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যাংকের জন্য মঙ্গলজনক। যাতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। পাশাপাশি অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে এ খাতে তদারকি বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সচল আছে। ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় কিন্তু বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে খারাপ করছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। তাদের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এছাড়া করোনার কারণে ঋণ আদায় ব্যাপক কমেছে। বিভিন্ন অনিয়মের খবরে সাধারণ গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে পড়েছে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০টি প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের সময় মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আবার অনেকে নানামুখী সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স ও উত্তরা ফাইন্যান্স অন্যতম।
এদিকে, অনিয়মের পরও দৃশ্যমান শাস্তি না হওয়ায় এ খাতে তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে অর্থ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে অবসায়কও (লিকুইডেটর) নিয়োগ দেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন হয়নি। জড়িত কেউ এখনও শাস্তি পায়নি। যারা লুটপাট করেছেন তারা বেশ আয়েশে আছেন।
অন্যদিকে, আমানতকারীরা পাওনা টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত বছরের নভেম্বরে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ছয় হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিন এর তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। তার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২ জন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদিকে, হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার আসামি পি কে হালদার চলতি বছরের ১৪ মে ভারতে আটক হন। এখন তিনি সেই দেশের জেলখানায় বন্দি। তার বিচার কার্যক্রম চলছে।