হুন্ডিতে ২ লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৮ পিএম, ২৮ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৫৫ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থান করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালাউদ্দিন। কাজ করছেন একটি ডাইং কারখানায়। মাসে বেতন পান দুই হাজার রিয়াল। ওভার টাইম আছে। ফলে সব খরচ বাদে মাসে দেড় হাজার রিয়ালের মতো থাকে। যার সিংহভাগ পাঠান দেশে। কীভাবে এ অর্থ দেশে পাঠান হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। বলেন, কয়েকটা মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাই। এখানকার ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকে অথবা বিকাশের মাধ্যমে। তবে, সহজ হয় হুন্ডিতে (নিষিদ্ধ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা) পাঠালে। প্রথমে ব্যাংকেই পাঠাতাম। রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে ফরম পূরণ করতে হয়, অনেক সময় কাগজপত্রও দিতে হতো। এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো। ওদের কথাও বোঝা যেত না। একদিন রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়ে অনেক সময় চলে যায়। ফলে ওই দিন আর কাজে যেতে পারিনি। পরে এক বন্ধু জানাল, ঝামেলার দরকার কী, হুন্ডিতে পাঠা। তার কথা মতো পরের মাসে হুন্ডি করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেশে টাকা চলে গেল। রেটও ব্যাংকের চেয়ে বেশি পেলাম। এরপর থেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠাই। মাঝে মাঝে ব্যাংকেও পাঠাই। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে তো দেশের ক্ষতি জানালে তিনি বলেন, বুঝি, কিন্তু কী করব? আমরা তো এখানে কষ্ট করে টাকা কামাই। সেই টাকা পাঠাতে যদি ভোগান্তি পোহাতে হয় তখন আর ভালো লাগে না। আপনি বলেন, যেখানে ভোগান্তি কম কিন্তু টাকা বেশি; সেখানে কেন যাব না? কয়েক মাস দেশের টানে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। এখন বিরক্ত লাগে। সকাল ৮টায় কর্মস্থলে যাই, ফিরি রাত ৮টায়; মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি খাওয়ার জন্য। এত কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠাই। অথচ খবরে শুনি দেশের সম্পদ লুটপাট হচ্ছে। আমাদের ঘামের টাকা তারা কেন লুটপাট করবে? এগুলো দেখলে আর দেশপ্রেম থাকে না, বলেন সালাউদ্দিন। অথচ হুন্ডিতে ডলারের রেট ধরা হয়েছে ১০৮ টাকা। অর্থাৎ ১০০০ ডলারের বিপরীতে ওই প্রবাসী পাবেন এক লাখ আট হাজার টাকা। তিনি ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে বেশি পাচ্ছেন ১০ হাজার ৫১৫ টাকা। ফলে, প্রবাসীরা অবৈধ জেনেও বেশি লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন।
হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর সুবিধার কথা জানিয়ে এই প্রবাসী আরও বলেন, এখন ব্যাংকের রেট ২৭ টাকা (রিয়াল)। আড়াই টাকা প্রণোদনা যোগ হলে পাব ২৯ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু এখানে একটা চার্জ কাটে, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০০ টাকা। তার মানে ২৯ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছি না। অথচ হুন্ডিতে আজকের রেট ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। টাকা বাসায় পৌঁছে দেবে। তাহলে কেন প্রবাসীরা ব্যাংকে টাকা পাঠাবে? রেমিট্যান্স পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই ভোগান্তি কমাতে হবে। টাকা পাঠানো সহজ এবং হুন্ডির সঙ্গে ব্যাংক রেটের যে ব্যবধান তা কমাতে হবে। তাহলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারব আমরা। সালাউদ্দিনের মতো একই সুরে সুর কথা বললেন মালয়েশিয়া প্রবাসী আল-আমিন।
তিনি বলেন, আট বছর হলো মালয়েশিয়ায় আছি। এখানে শ্রমিকের কাজ করি। সকালে যাই, বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাঝে দুপুরের খাবারের বিরতি। এর বাইরে সময় হয় না। তাই যখন যেভাবে দেশে টাকা পাঠাতে সুবিধা হয় সেভাবেই পাঠাই। গত মাসে ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছি। এ মাসে হুন্ডিতে পাঠালাম। হুন্ডিতে রেট বেশি পাওয়া যায়। ব্যাংক গত মাসে ২১ টাকার (রিংগিত) মতো দিয়েছে। হুন্ডিতে পেয়েছি ২৫ টাকার ওপরে। প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, বিদেশ থেকে দেশে বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাতে শুধু একটা কল (ফোন কল) দিলেই চলে। অর্থাৎ যেকোনো জায়গায় বসে বিদেশের দোকানে বা এজেন্টকে ফোন দিয়ে অর্থের পরিমাণ বলে দিলেই হয়। তারা সমপরিমাণ টাকা হয় মোবাইল অ্যাকাউন্টে অথবা সরাসরি গ্রামে বা শহরের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে। সৌদির জেদ্দায় কিলো আরবাতাস নামক স্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসবাস বেশি। সেখানে প্রকাশ্যে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান বেশকিছু ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের মোহাম্মাদ আলী ও কুমিল্লার আব্দুল হামীদ। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মুন্সিগঞ্জের মানুষ তাদের কাছে বেশি আসেন। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে ব্যাংক নেই, মানুষজনও তেমন শিক্ষিত না, ওইসব এলাকার প্রবাসীরা হুন্ডিতে বেশি টাকা পাঠান। তাদের নিজস্ব কিছু এজেন্টও আছে। বিশেষ করে বিকাশ, রকেট ও নগদের এজেন্টরা তাদের সঙ্গে কাজ করেন। তারা সরাসরি এজেন্টদের ফোন করে যে নম্বরে টাকা পাঠাতে বলেন, তারা ওই নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। তাদের নির্ধারিত লোকজন এজেন্টদের ওই টাকাসহ কিছু কমিশন দিয়ে থাকেন। প্রবাসীদের হুন্ডির অর্থ দেশের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেন আকবর হোসেন (ছদ্মনাম)।
তিনি বলেন, বিদেশে অবস্থানরত এজেন্টরা আমাদের নম্বর দিয়ে বলেন, এই নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেই। কোনো সময় বিকাশ নম্বর, আবার কোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়। কাছাকাছি হলে নগদ টাকাও পৌঁছে দেই। এজেন্টের মতো কাজ করি। লাখে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পাই। বাজার ভালো হলে আয়ও বেশি হয়।
টাকা কে পরিশোধ করেন জানতে চাইলে আকবর বলেন, একেক সময় একেকভাবে টাকা পরিশোধ করা হয়। কোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, অনেক সময় বিকাশে লোড দেয়। আবার ক্যাশ টাকাও দেয়। তবে, টাকা কখনও বাকি থাকে না। গাজীপুরের সৌদি প্রবাসী আবুল কালাম বলেন, হুন্ডিতে লাভ বেশি, ঝামেলা কম। অন্যদিকে, ব্যাংকে খরচ বেশি, পেড়াও কম দেয় না। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ধরেন, গতকাল আমি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাব। এক হাজার রিয়ালে আমাকে দেয়া হবে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। এখান থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো চার্জ কেটে নেয়া হবে। অর্থাৎ প্রণোদনার আড়াই শতাংশই কেটে নেয়া হবে। যদি হুন্ডিতে পাঠায় তাহলে পাব ৩০ হাজার টাকা; কোনো চার্জও কাটবে না। ফোন করে বললেই পাঠিয়ে দেবে। তাহলে কোন মাধ্যমে টাকা পাঠাব, আপনিই বলেন? বৈধ মাধ্যমে (ব্যাংক) কোনো সময় টাকা পাঠিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক আগে পাঠিয়েছি। কারণ, ওই সময় ব্যাংকের রেট বেশি ছিল। করোনার সময় হুন্ডিতে পাঠালে বেশি লাভ হতো না। তবে, এখন অনেক বেশি রেট। যে যত বেশি টাকা পাঠায় রেটও তত বেশি পায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে ২০২১ সালে সবকিছু বন্ধ ছিল। তখন হুন্ডির প্রভাব কমে যায়। বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়ে যায়। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। ভ্রমণ, কর্মসংস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি এসেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকে ডলারের রেট ও কার্ব মার্কেটের (খোলাবাজার) রেটের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। মানুষও হুন্ডির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কমছে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার) টাকার রেমিট্যান্স পাঠায় প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ডলারের দর ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে, বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংক বলছে, তারা ৯৭ টাকায়ও ডলার কিনছে। সেই হিসাবে, কোনো প্রবাসী যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে ১০০০ ডলার পাঠান, তাহলে তিনি পাবেন ৯৭ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হবে। অর্থাৎ ১০০০ ডলার পাঠালে পাবেন ৯৯ হাজার ৪২৫ টাকা। তবে, এখান থেকে প্রতিষ্ঠান ভেদে এক থেকে দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে এক হাজার ৯৪০ টাকা কাটা পড়ে। এই হিসাবে চার্জ বাদ দিয়ে ১০০০ ডলারের বিপরীতে একজন প্রবাসী পাবেন ৯৭ হাজার ৪৮৫ টাকা।
অথচ হুন্ডিতে ডলারের রেট ধরা হয়েছে ১০৮ টাকা। অর্থাৎ ১০০০ ডলারের বিপরীতে ওই প্রবাসী পাবেন এক লাখ আট হাজার টাকা। তিনি ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে বেশি পাচ্ছেন ১০ হাজার ৫১৫ টাকা। ফলে, প্রবাসীরা অবৈধ জেনেও বেশি লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করা কিছু সংস্থা ও গবেষকদের মতে, দেশের রেমিট্যান্সের বাজার ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। যার অর্ধেক আসে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আসে বিষয়টি স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক কর্মশালায় উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী অফিসিয়াল চ্যানেলে এসেছে ৫১ শতাংশ টাকা। হুন্ডিতে এসেছে ৪৯ শতাংশ। তিনি প্রবাসীদের প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে অনুরোধ করেন। বলেন, হুন্ডিতে টাকা পাঠানো নিরুৎসাহিত করতে আমরা অফিসিয়াল চ্যানেলে টাকা দেশে আনার সুফল সবাইকে জানাচ্ছি। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আফ্রিকা, মালদ্বীপ, ইরাকসহ বেশকিছু দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা সীমিত। মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে হুন্ডি লেনদেন হয়। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশেষ করে দুবাই হয়ে ব্যাপক হুন্ডি লেনদেন হয়। তারা স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে কাজ করেন। দেশের আমদানি ও রফতানিকারকগণও অবৈধ এ লেনদেনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এছাড়া যেসব প্রবাসী বিদেশে অবৈধ হয়ে পড়েন, তারাও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসী শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন। এ টাকা বৈধ পথে পাঠালে সরকারের লাভ হয়। যখন হুন্ডিতে পাঠায় তখন তিনি লাভবান হন। এখন যে মাধ্যমে অর্থ পাঠালে প্রবাসী বেশি লাভবান হবেন, তিনি ওই মাধ্যমে পাঠাবেন। এটাই স্বাভাবিক। এখন ব্যাংকের ডলার রেটের সঙ্গে হুন্ডির রেটের একটা বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এক ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে প্রবাসী পাচ্ছেন ৯৬ টাকা। এর সঙ্গে ইনসেনটিভ যোগ হলে পাচ্ছেন ৯৮ টাকা ৫০ পয়সা; অথচ ইনফর্মাল চ্যানেলে এ রেট ১১৫ থেকে ১১৯ টাকা। তার মানে, একজন প্রবাসী হুন্ডিতে টাকা পাঠালে প্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি পাচ্ছেন। তাহলে কেন তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাবেন? প্রবাসীরা তো বিদেশে গেছেন টাকা রোজগারের জন্য। যেখানে বেশি রেট পাবেন তিনি সেখানেই যাবেন। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর উপায় কী জানতে চাইলে এই অধ্যাপক বলেন, এখন যদি সরকার বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনা বাড়াতে চায় তাহলে ফর্মাল অর ইনফর্মাল চ্যানেলের দামের যে ব্যবধান তা অবশ্যই কমাতে হবে। এটার উদ্যোগ রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
যখন রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা হয় তখন কিন্তু আমাদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। কারণ, ওই সময় হুন্ডি ও ব্যাংকিং চ্যানেলের রেট প্রায় সমান ছিল। এখন ব্যবধান যেহেতু ১০ থেকে ১৫ টাকা; সরকারের উচিত হবে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো। একই সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর শর্ত সহজ করা, বলেন ড. তাসনীম সিদ্দিকী। ব্যাংকারদের মতে, অর্থপাচারের জন্যও হুন্ডি এখন উত্তম মাধ্যম। প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডির কারণে এখন আর দেশে আসছে না। ওই অর্থ দেশের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এসব অর্থ সেকেন্ড হোমের নিবন্ধন, বাড়ি ও গাড়ি কেনাসহ নানা ধরনের কাজে ব্যয় হচ্ছে। ডিজিটাল হুন্ডি অর্থপাচারকারীদের কাজটি সহজ করে দিয়েছে, মনে করেন তারা। বিষয়টি স্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে কাজ করা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ডলারের সংকটের পর আমরা বিভিন্ন ডিজিটাল ওয়ালেটের ওপর নজর রাখি। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অনিয়মও আমরা পাই। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারছি না। কারণ, এসব অনিয়ম ধরার মতো টেকনিক্যাল দক্ষতা আমাদের নেই। এসব বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে হবে। তা না হলে সামনে আরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। হুন্ডি বন্ধে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। রেমিট্যান্সের বড় উৎসের দেশগুলো; বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইটালি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এসব দেশের দূতাবাসগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে খুব দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। এছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ শাখার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে জেলায় জেলায় বিশেষ টিম গঠন করে হুন্ডি লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট- ২০১২’ সহ প্রযোজ্য সকল প্রচলিত আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। দূতাবাসগুলোতে কোনো প্রবাসীকর্মী সেবা নিতে গেলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সিøপ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি প্রণোদনার হার আরও বাড়াতে হবে।
হুন্ডি প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা [ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রেমিট্যান্স হুন্ডি হওয়া মানেই অর্থপাচার। অর্থাৎ দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসার কথা ছিল তা আসছে না। বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু দেশে সমপরিমাণ অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এর প্রভাবে গতকাল টাকার সঙ্গে ডলারের মূল্যের এত ব্যবধান। হুন্ডি রোধে কী করা প্রয়োজন জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, প্রথমে যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসীরা যেন হুন্ডিতে অর্থ না পাঠান এজন্য অফিসিয়াল চ্যানেলে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। যাতে বৈধ পথে হুন্ডির সমপরিমাণ অর্থ তিনি পান। তবে, এ সুবিধা সবাইকে না দিয়ে শুধুমাত্র প্রবাসী শ্রমিকদের দিলে ভালো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, যখন রফতানির তুলনায় আমদানি বাড়ে তখন ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়। যা এখন দেখা যাচ্ছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স বেশি বেশি আনতে বলা হয়েছে। যত সহজে রেমিট্যান্স আনা যায়, সে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকার রেমিট্যান্সের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ হার আরও বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কী পরিমাণ অর্থ হুন্ডি হচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই মুখপাত্র। তবে, হুন্ডি হচ্ছে এটা স্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েকটি মাধ্যমে হুন্ডি হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো- আমদানির মাধ্যমে পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে বিদেশে অর্থপাচার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন তিন মিলিয়ন বা তার বেশি ডলারের পণ্য কেউ আমদানি করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২৪ ঘণ্টা আগে জানাতে বলা হয়েছে। ফলে আমদানিতে এখন অনেক অসঙ্গতি পাচ্ছি। দেখা যাচ্ছে, আমদানি পণ্যের মূল্য দেয়া আছে দুই ডলার; কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখছি এটি দেড় ডলার। তখন তাকে আর আমদানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ আমদানির মাধ্যমে যে অর্থ পাচার হচ্ছিল তা থেমে গেছে। এখন যেটা হচ্ছে সরাসরি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন। এ বিষয়ে আমরা বেশ সতর্ক। ব্যাংকগুলোকেও বলা হয়েছে, রেমিট্যান্স আনার জন্য সেবার মান বাড়াতে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স তার মনোনীত ব্যক্তির কাছে তাৎক্ষণিক বা সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দিতে। এজন্য নিয়মনীতি যত সহজ করা দরকার তা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার জন্য প্রবাসীদের কাছে ইতিবাচক প্রচারণা চালানোসহ বিভিন্ন সুবিধার কথা জানাতে ব্যাংক ও বিদেশি দূতাবাসগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে ডলার পাচার হচ্ছে কি না তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে আসার পর এবার অর্থপাচার বা হুন্ডিতে কোনো মানি-চেঞ্জারের সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ। সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহের পর এখন পর্যন্ত ২৮টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছে ইউনিট। তারা সরেজমিনে পাওয়া বিভিন্ন ডকুমেন্টের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন যাচাই করছে। এদিকে, ডিজিটাল হুন্ডিতে জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ এজেন্টের তথ্য চেয়েও চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। অন্যদিকে, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাচার করে এমন একটি চক্রের ছয় সদস্যকে গত ২২ আগস্ট রাতে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অভিযান চালিয়ে আটক করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগের পুলিশ। পরে এক বিবৃতিতে পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশিদের মাধ্যমে পরিচালিত মোবাইল ফোনের দোকান এবং ট্রাভেল এজেন্সির আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা করে আসছিল এমন কিছু প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে হুন্ডির অর্থ ও সংশ্লিষ্ট মালামাল জব্দ করা হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, চক্রটি প্রতি মাসে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন রিংগিত (প্রায় আড়াই কোটি টাকা) হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাত। মালয়েশিয়ায় অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিরাই ছিল তাদের গ্রাহক।