ডিএসইর ১০ এমডির ৬ জনেরই পদত্যাগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৪ পিএম, ২৮ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:২৬ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
গত ২৫ বছরে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ১০ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন এমডি পূর্ণমেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি ছয়জনের কেউই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি, তার আগেই পদত্যাগ করেছেন। ফলে এ সময়ে ‘ধার করা’ আরও তিনজনকে দিয়ে চালাতে হয়েছে ডিএসই।
ডিএসইর তথ্য মতে, ২০১৩ সালে ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণ বা ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর ডিএসইতে চারজন এমডি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন মেয়াদের পূর্ণ সময় অর্থাৎ তিন বছর শেষ করেছেন। আর বাকি দুজন আগেই পদত্যাগ করেছেন। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আগে এমডি পদের নাম ছিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। এ পদে ছয়জন সিইও দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে দুজন তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। আর বাকি চারজনই মেয়াদের আগে পদত্যাগ করেছেন। এ ছয় সিইও নিয়োগের আগে ভারপ্রাপ্ত সিইও (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চারজন। তারা হলেন মফিজ উদ্দিন আহমেদ, খায়রুজ্জামান, শুভ্র কান্তি চৌধুরী ও আব্দুল মতিন পাটোয়ারী। ডিএসইতে প্রথম সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জি কিউ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন রেজাউর রহমান। সেই সময় তিনি ডিএসইর সিএফও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পরে তাকে তিন বছরের জন্য ডিএসই বোর্ড থেকে সিইও হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ২০০১-০২ সাল পর্যন্ত মাত্র এক বছর দায়িত্ব পালনের পর পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি দুই বছর এ অতিরিক্ত পদে দায়িত্ব পালনে করেন। এরপর সিইও হিসেবে যোগ দেন করেন সালাউদ্দিন আহমেদ খান। তিনি ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেন। তাকেই ডিএসইর ইতিহাসে সফল সিইও বা এমডি বলা হয়ে থাকে। সালাউদ্দিনের পর কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত সিইওর দায়িত্ব পালনের পর সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন এ এফ এম শরীফুল ইসলাম। কিন্তু কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে ২০০৯ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। তার মতো কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সতিপতি মৈত্র। তারপর তিনি পুঁজিবাজারে সবচেয়ে আলোচিত সময়ে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বোর্ডের সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিনিও পদত্যাগ করেন। তারপর খায়রুজ্জামান ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর সিইও হিসেবে এক বছর (২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) দায়িত্ব পালন করেন মোশাররফ এম হোসেন। তিনিও পদত্যাগ করেন। তারপর ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিএফও শুভ্র কান্তি চৌধুরী।
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে হয় ডিমিউচুয়ালাইজেশন। এরপর প্রথম এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রয়াত স্বপন কুমার বালা। তার মেয়াদ (২০১৩-১৬) শেষ হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারি। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল তিন বছর এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কেএএম মাজেদুর রহমান। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবারও ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মতিন পাটোয়ারী। এরপর এমডি হিসেবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যোগ দেন করেন কাজী সানাউল হক। মাত্র ১১ মাস দায়িত্ব পালন করে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেন। তারপর আবারও কিছুদিন এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মতিন পাটোয়ারী। তিনিও ২০২১ সালের আগস্ট মাসে পদত্যাগ করেন। মতিন পাটোয়ারির পদত্যাগের কিছুদিন আগেই এমডি হিসেবে তিন বছর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে ২৫ জুলাই ২০২১ সালে যোগদান করেন তারিক আমিন ভূঁইয়া। তিনিও মাত্র ১৩ মাস দায়িত্ব পালন করে গত ২৪ আগস্ট পদত্যাগ করেন। প্রভাবশালীদের চাপে এবং কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট রেষারেষিতে পদত্যাগ করেছেন ডিএসইর এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়া। তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাওয়া এ এমডিকে ১৩ মাসের মাথায় পদ ছাড়তে হলো। ২৫ আগস্ট ডিএসইর বোর্ড তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে।
তারিক আমিন ভূঁইয়া বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি গ্রুপ অযৌক্তিক মূল্য দেখিয়ে আইটি প্রজেক্ট নিয়েছে। আমি সেটিতে বাধা দিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত। পর্ষদের এই অংশটি আমাকে বের করে দিতে কাজ করেছে। তিনি বলেন, আমি পর্ষদের সঙ্গে কথা বলে কয়েকজনকে প্রমোশন দিয়েছি। কিন্তু তাদের পছন্দমতো কিছু লোককে প্রমোশন না দেওয়ায় তারা আমার বিরুদ্ধে নেমেছে। তিনি আরও বলেন, তিন বছর ধরে প্রমোশন দেওয়া হয় না। ক্ষমতা অনুযায়ী ১১৪ জনকে প্রমোশন দিতে পারি। কিন্তু আমি দিয়েছি ৯৫ জনকে। আর প্রমোশন দেওয়ার এখতিয়ার কেবল এমডির, এটিই আমি করেছি। কিন্তু তারপরও এটি নিয়ে তারা আমার সঙ্গে বাড়াবাড়ি করেছে, আমাকে বোর্ড মিটিং থেকে বের করে দিয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমডি পদটি পুরোপুরি ‘মিউজিক্যাল চেয়ারে’ পরিণত হয়েছে। আর প্রভাবশালীদের চাপে কোনো এমডিই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। চাপ সামলে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন এমডির সংখ্যা খুবই কম। ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ডিমিউচুয়ালাইয়েশনের আগে বলা হতো শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা এমডিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। এখন তো শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা সংখ্যালঘু। এখন দায় কার?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এমডির ওপর থেকে পর্ষদের প্রভাব মুক্ত করতে স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইয়েশন করা হয়েছে। তারপও এমডির ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ কোনোভাবে কাম্য নয়। এমডি যদি আইনের ব্যত্যয় করেন, কমিশন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু একটি মহলের স্বার্থ রক্ষা না করায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়, এটি ঠিক নয়। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। প্রতিষ্ঠানটিতেও এমডি নেই প্রায় ১০ মাস। ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে সংস্থাটি চলছে এখন। সেখানেও এমডির দায়িত্ব পালন অনেকাংশে নির্ভর করে প্রভাবশালীদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ওপর।