দায়িত্ব এক জেলার, দুই জেলার উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষর!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৯ পিএম, ২৩ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৭ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
এক জেলার দায়িত্বে থাকাকালে দুই জেলার উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষরের অভিযোগ পাওয়া গেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) এক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। তিনি হলেন ইইডির চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। দুর্নীতি ও নিম্নমানের অবকাঠামো নির্মাণের অভিযোগে তিনি বারবার সমালোচিত হয়েছেন। তবে এগুলোর কোনো দায় তাকে নিতে হয়নি। তাকে বরং পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, দেলোয়ার হোসেন মজুমদার কুমিল্লা জেলার সহকারী প্রকৌশলী (ইইডি) থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে ভোলা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই আদেশে আটজন কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলেও দেলোয়ার হোসেন যোগদান করেননি। তিনি ২০১১ সালের জুন মাসেও কুমিল্লা জেলার সব উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষর করেন এবং সব দাফতরিক কাজে (কুমিল্লা) তার স্বাক্ষরের কাগজপত্র বিদ্যমান আছে। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা জোনের যাবতীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন দেলোয়ার হোসেন। সেই সময়ে ভোলা জোনের দায়িত্বে থেকে ইউনুস আলী ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের সব বিল প্রদানসহ দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করেন। দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ওই সময়ে ভোলা জোনের কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি বা তার স্বাক্ষরে কোনো বিল পাশ হয়নি। অথচ তিনি পুরোনো তারিখে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যোগদানপত্র দাখিল করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট জোনের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের নানা রকম প্রশাসনিক জটিলতা ও বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। বিভিন্ন ধরনের নথি নিষ্পতিতেও জটিলতা দেখা দেয়। এ কারণে ইইডির প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন তদবিরের চাপে এ ঘটনায় কোনো তদন্ত হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ঠিকাদারদের সঙ্গে কমিশন ভাগাভাগির জন্যই এক জেলার দায়িত্বে থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য জেলার ঠিকাদারদের বিল ছাড় করা হয়েছিল। পরবর্তীতে যখন ওই জেলায় নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী পদায়ন পান তখন জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পায়। এ ছাড়াও এই প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা ভোলা সরকারি কলেজে ‘পাঁচতলা ভিত বিশিষ্ট চারতলা’ একটি ভবন পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে তিন দফা তদন্ত হলেও দায়ী কর্মকর্তার কোনো শাস্তি হয়নি। উল্টো তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সম্প্রতি অপর একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ওই কর্মকর্তাকে শাস্তির প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর দুর্নীতির কারণে ভোলা সরকারি কলেজে নবনির্মিত ৫তলা ভিতবিশিষ্ট চারতলা ‘একাডেমিক ভবন কাম এক্সামিনেশন হল’ পরিত্যক্ত ঘোষণা হচ্ছে। ২০১৯ সালে ইইডির প্রকৌশলীরা ভবনটির চারতলা ছাদকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। কারণ ভবনটির পলেস্তারা খসে পড়ছে। কাজের মান ভালো না হওয়ায় পাঁচ তলার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ’ প্রকল্পের পক্ষ্ থেকে বারবার তাগাদাপত্র দেয়া সত্ত্বেও ভবনটির কাজ ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ঠিকাদারকে পুরো বিলই পরিশোধ করা হয়েছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনটির চারতলা ছাদে নির্ধারিত মাপের চেয়ে কম রড ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদের সø্যাব থিকনেস ড্রইংয়ের থিকনেস থেকে কম। এতে ছাদে জোরে চলাফেরা করলে শব্দ সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে ভোলা সরকারি কলেজের পাঁচতলা ভিতবিশিষ্ট ভবনটির প্রথম তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজটি সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়। এরপরই ভবনটির নিম্নমানের নির্মাণ কাজ চিহ্নিত হয়। এরপর ২০১৮ সালে ইইডি কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। ওই বছর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের ৪র্থ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়। ইইডির পরিদর্শন ও তদন্ত কমিটি ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যাতে নির্মাণ কাজে বড় ধরনের অনিয়ম শনাক্ত হয়। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্তকে বাদ দিয়ে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত ও একজন মৃত প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আগামী ছয়মাসের মধ্যে ওই ভবনটি মেরামতের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ভবনটির নির্মাণ কাজ তিন থেকে চারবার করে পরিদর্শন করেছেন ইইডির প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ ডিজাইনার জয়নাল আবেদীন, নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মুয়াজ্জেম হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সমীর কুমার রজক দাস প্রমুখ।
জানা গেছে, ভোলা কলেজের ভবন নির্মাণের সময় ইইডির ‘ভোলা অঞ্চল’র নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক (ডিপি) মামলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষ দিকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি ইইডির চট্টগ্রাম সার্কেল প্রধানের দায়িত্বে আছেন। ভোলা কলেজে নির্মাণ কাজে দুর্নীতির বিষয়ে সম্প্রতি আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছিল সাবেক শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেন। কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে এবার দায়সারা গোছের একটি প্রতিবেদন জমা হয়েছে, যাতে দেলোয়ার হোসেনের দায় চাপানো হয়েছে একজন মৃত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং তিনজন অবসরপ্রাপ্ত কনিষ্ঠ কর্মকর্তার ওপর।
অভিযোগের বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন মজুমদারকে বলেন, আমি যখন থেকে ভোলায় যোগদান করেছি, তখন থেকেই ভোলার কাজ করেছি। কোনো সচেতন অফিসার এই কাজটা করবে না। ভিসি মহোদয়ের অনুরোধে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কাজ চলছিল তখন তৎকালীন সচিব স্যারও আমাকে কাজটা শেষ করে দিতে বলেছিলেন। কারণ কুমিল্লা নিয়ে খুবই অসুবিধায় ছিলাম আমরা, কাজের মান খুব খারাপ ছিল। তখন ভিসি স্যার সচিব স্যারকে বলেছিলেন সেই অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী আমাকে চিঠিও দিয়েছেন কাজ শেষ করার জন্য। আমি কি এত কাঁচা? প্রমোশন পাইলাম এরপর ভোলা থেকে কুমিল্লার কাজ করব? এটা কখনো হতে পারে না, এটা ফলস।
তিনি বলেন, যখনই আমার একটা সম্ভাবনা সামনে আসে। তখনই একটি পক্ষ যারা আমাকে পছন্দ করে না তারা এগুলো করে। এখন নাঈমুল সাহেব (পিআরএল) অবসরে যাবেন ১৫ অক্টোবর। এখন পুরনো একটা জিনিস নিয়ে আমার কোথায় কি আছে এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করছে। আর কিছু না।