গরিব আছে সংকটে মধ্যবিত্ত দিশেহারা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:২৯ পিএম, ১৮ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৫৪ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
দেশে বহুদিন ধরেই নানা সংকট চলছে। এক সংকটের পর আরেক সংকটের আবির্ভাব। তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি এটা আর নতুন কিছু নয়। এদেশে বহুকাল ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে, দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটিসহ ওষুধপত্র ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্যের দাম। শুধু তাই নয়, বরং নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষগুলোর প্রিয় খাবার ডিম। সেই ডিমের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবেই মোটা চালের কেজি এখন ৪৮ টাকা হয়েছে। বাজারে যা কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যের দামের কথা যদি বলি তাহলে দেখা যাবে, খোলা সয়াবিন তেল ১৯০, পাম অয়েল ১৫০, দেশি পেঁয়াজ ৫৫ , আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০, ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি ৬০ টাকা এবং প্রতি শাকসবজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষরা একটু ডাল-ভাত কিনে খাবে সে উপায়ও নেই। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষজনের জীবনযাপন করতে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বলা যায় যে, গরিব আছে সংকটে আর মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলান করার কোনো পথ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ জনগণের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। বর্তমান সময়ে দেশে সংকটে ভুগছে চা-শ্রমিকরা। দেশে বর্তমান চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭ টি। যার মধ্যে সর্বোচ্চ মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত ৯২টি চা বাগান। আর এই চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। অর্থাৎ মাসিক ৩৬০০ টাকা বেতন। এই সীমিত আয় দিয়ে বর্তমান বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর যে দাম সেই তুলনায় এই টাকা কিছুই না। ফলে তাদের পরিবারের ভরণপোষণ করতে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরকে দিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনিতে প্রতিবছর চা শিল্পে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন কেজি চা, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড। চা শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে যারা। কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে আন্দোলন চলছে, ধর্মঘট হচ্ছে। তবু যদি তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় তাহলেই সার্থক আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যথায় যদি সার্থক না হয় তাহলে চা শ্রমিকদের এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। ফলে চা শিল্পের উন্নয়নে বাধা-বিপত্তির আশঙ্কা দেখা দেবে। কাজেই এখনই সময় চা শিল্পের উন্নয়নে, শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভাবা আর তাদের দাবি বাস্তবায়ন করা। আমাদের দেশে একটি বৃহৎ অংশ ছাত্রসমাজ। যাদের মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে আসে। আর এখানে এসে থাকতে হয় মেস কিংবা ভাড়া বাসায়। যদিও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেটি সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। ফলে তাদের মেস কিংবা ভাড়া বাসায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ফলে তারা তাদের পড়াশোনা এবং নিজ খরচ পরিচালনা করার জন্য টিউশনি কিংবা যেকোনো পার্টটাইম জব করে থাকে। কিন্তু তাদের এই সীমিত আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। কারণ বর্তমান সময়ে দেশের বাজারের দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা এতে ব্যাচেলরদের জীবনযাপনে চরম শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে। বলা যায় অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনপাত করছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের এই শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে তা আর কমার নজির নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে পেট্রোল, এলপি গ্যাস ও ভোজ্য তেলের দাম কতবার বেড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমার খবর প্রকাশ হলেও দেশের বাজারে তা কমার কোনো খবর নেই। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ জনগণ প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতেই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। তাই সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে টিসিবির বুথ বাড়িয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে ৮-১০ বছর আগেও টিসিবির পণ্য কিনতে ১০-১৫ জনের বেশি লোক দেখা যেত না। আর এখন সর্বত্র টিসিবির পণ্য কিনতে শত শত লোক দীর্ঘ লাইন ধরছে একটু সাশ্রয়ে মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য। এখন কথা হচ্ছে, এসব কীসের আলামত? উন্নয়নশীল দেশে এমন তো হওয়ার কথা নয়। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ যদি খুঁজি তাহলে দেখা যাবে, এদেশে চাহিদা ও জোগানের সমতার অভাব রয়েছে বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা প্রচুর কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জোগান পর্যাপ্ত নয়। ফলে দেখা দিচ্ছে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি। মুদ্রাস্ফীতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। প্রতিবছর যদি ৫ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয় তাহলে অবশ্যই দ্রব্য উৎপাদনের খরচ বাড়বে ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত দ্রব্য এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অনুপাতে সমান নয়। কোথাও বেশি আবার কম। কিন্তু বেশি হওয়ায় সমাজে সম্পদের অপ্রতুলতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদা বাড়তে থাকলে দ্রব্যের মূল্যও বাড়তে থাকে। আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে পণ্য উৎপাদন বাড়ছে না। এজন্য দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বাংলাদেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও দায়ী। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অনেকেই দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেন। কিছু কিছু আড়তদার আছেন, যারা পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এর ফলে দ্রব্যমূল্য হঠাৎ বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে এসব আড়তদার ও মজুদদার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দায়ী। বাংলাদেশে অনেক খাতে দুর্নীতি বিদ্যমান। এই দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়া। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত তারা শাস্তি পায় না। ফলে আবারও সেই একই কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ পাশাপাশি করোনা এবং সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এদেশের সাধারণ মানুষেরা একটু সুখ-শান্তি নিয়ে বাঁচতে চায়। একটু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। তাদের সব কাজে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেতে চায়। আর এসব কিছু বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ নজর দিতেই হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর সব নিত্যপণ্যের মজুদ মনিটরিংয়ের আওতায় এনে সরকারিভাবে মজুদ বাড়াতে হবে। নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মজুদকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেইসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটেরদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেন তাদের শাস্তি দেখে বাদবাকি সবাই এমন ঘৃণ্য কাজ করতে সাহস না পায়। পণ্য সংকটের অজুহাতে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দেশে কৃষিজ উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। নয়তো এভাবেই চলতে থাকলে জনগণের জীবনযাপন করতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ দেশটা সবার। এই দেশ ও মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্বও সবার।