চট্টগ্রাম বন্দরে ৫ কনটেইনার মদ জব্দ : ২৫ কোটি টাকা পাচার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪৪ পিএম, ২৭ জুলাই,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:০০ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় গার্মেন্টসের সুতা, কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানির কথা বলে আনা হয়েছে বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের মদ। এসব মদ আমদানিতে একদিকে যেমন রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে দেশি টাকা বিদেশে পাচার। বন্দর থেকে খালাস নেয়া দুই চালানে দুই কনটেইনার মদ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে জব্দ হওয়ার পর প্রকাশ পায় এসব জাল-জালিয়াতির। পরবর্তীতে বন্দর অভ্যন্তরে জব্দ করা হয় আরও তিন কনটেইনার মদ। এ ঘটনায় কাস্টমস কর্মকর্তারা জানতে পারেন, কাস্টমসের একজন রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি হ্যাক করে খালাস হওয়া মদের চালান দুটি শুল্কায়ন করা হয়েছে।
এরপর কাস্টমসের তদন্তে জানা গেছে, রবি কোম্পানির একটি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ওই আইডিটি হ্যাক করা হয়েছে। আইডি হ্যাক করে শুল্কায়ন কার্যক্রমের ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজির দেউরি এলাকায়। অন্যদিকে আটক হওয়া ৫ কনটেইনার মদের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ঘোষিত শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হিসাব করা হলে প্রত্যক্ষভাবে কমপক্ষে ৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা পাচার হয়েছে।
তবে, জব্দ করা মদের আন্তর্জাতিক বাজারদর বিশ্লেষণ করে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে দাবি কাস্টমসের।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার নূর উদ্দিন মিলন বলেন, জালিয়াতি এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মদ আমদানি করা হয়েছে।প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।
কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, ২২ জুলাই (শুক্রবার) দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জে জব্দ হওয়া ঈশ্বরদী ইপিজেডের বিএইচকে টেক্সটাইল লিমিটেডের জন্য আনা কনটেইনারটিতে ১৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকার পণ্য ঘোষণা দেয়া হয়। পাশাপাশি কুমিল্লা ইপিজেডের হেশি টাইগার কোম্পানি লিমিটেডের নামে আনা কনটেইনারটিতে ১৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকার পণ্যমূল্য ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু জব্দ করার পর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে কনটেইনার দুটিতে ১৩৩০ কার্টনে ৩১ হাজার ৬২৫ দশমিক ৫ লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া যায়। কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনার দুটিতে জব্দ মদের শুল্কায়নযোগ্য পণ্যমূল্য পান ৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। চালান দুটিতে ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস। প্রথম আটক হওয়া এ দুই কনটেইনারে নিশ্চিতভাবে কমপক্ষে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা পাচার হয়েছে বলে ধারণা কাস্টমসের। ২৪ জুলাই (রবিবার) সকালে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোম্পানি লিমিটেডের নামে টেক্সটাইল সুতা আনার ঘোষণা দিলেও কনটেইনার বেরিয়ে আসছে মদের চালান। জব্দ হওয়া চালানটিতে পণ্যমূল্য ঘোষণা দেয়া হয় ১৬ লাখ ৬ হাজার টাকা। শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে চালানটিতে এক হাজার ৪৩০টি কার্টনে ১৫ হাজার ২০৪ লিটার মদ পাওয়া যায়। জব্দ হওয়া মদের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ছিল দুই কোটি তিন লাখ টাকা। চালানটিতে ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়। চালানটিতে কমপক্ষে এক কোটি ৮৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা পাচার হয়েছে বলে ধারণা করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে, গত ২৫ জুলাই বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে জব্দ করা হয় আরও দুই কনটেইনার মদ। নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোম্পানি লিমিটেডের নামে প্যাকেজিংয়ের উপকরণ ঘোষণায় একটি ও বাগেরহাটের মোংলা ইপিজেডের ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে টেক্সটাইল সুতা আনার ঘোষণায় চালান দুটি আমদানি করা হয়। আগের তিনটি চালান খালাসের জন্য বিএল অব এন্ট্রি সাবমিট করেছিলেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স জাফর আহমদ। শেষের চালান দুটিতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না হওয়ায় ঘোষণা মূল্য পাওয়া না গেলেও শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে কনটেইনার দুটিতে ২৮৫৮ কার্টনে ৩১ হাজার ৪৯২ দশমিক ৫ লিটার মদ এবং ১০ লাখ ৬০ হাজার শলাকা বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের আমদানি নিষিদ্ধ সিগারেট পাওয়া যায়। জব্দ হওয়া চালান দুটিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা শুল্কায়নযোগ্য মূল্য পেয়েছে ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। চালান দুটিতে প্রায় ২০ কোটি ৬৮ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছিল। আগের দুই চালানের ঘোষিত মূল্যের সঙ্গে শুল্কায়ন মূল্যের গড়ে হিসেব করলে শেষের দুই চালানের ঘোষিত পণ্যমূল্য দাঁড়ায় ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এতে শেষের দুই কনটেইনারে কমপক্ষে ৩ কোটি ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা কাস্টমসের। হিসাব অনুযায়ী ৫ কনটেইনারে সবমিলিয়ে কমপক্ষে ৯ কোটি ১৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা পাচার করা হয়েছে। সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৫৭ কোটি ৮৩ হাজার টাকা।
কাস্টমসের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার মো. সাইফুল হক বলেন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্পগুলোর কাঁচামাল কিংবা মেশিনারিজ আমদানিকে কোনো শুল্ককর থাকে না। বেপজা’র (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি) আইপি (ইমপোর্ট পাস) নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো এসব পণ্য আমদানি করেন। কিন্তু জালিয়াতচক্র শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য আইপি জালিয়াতি করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মদ আমদানি করেছে। কাস্টমসের আন্তরিকতা, দক্ষতা ও দ্রুত পদক্ষেপের কারণে একে একে পাঁচটি চালান জব্দ করা সম্ভব হয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখেছি— আইপি কোথাকার দেখেছি। আমাদের একজন কর্মকর্তার আইডি হ্যাক করেই এ আইপি কম্পিউটারের কানেক্ট করা হয়েছে। এখানে একটি রবি মোবাইল ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনার সময়ে আমরা রবি মোবাইলের অবস্থান পেয়েছি কাজির দেউড়ি এলাকার টাওয়ারে সংযুক্ত। তবে সুনির্দিষ্ট কোন স্থানে হয়েছে সেটি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এসবে নির্ধারণ করার বিষয়েও কাস্টমসের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে বলে জানান তিনি।
এ কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, এনবিআরের শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী আমরা শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন গার্মেন্টের সুতা কিংবা উপকরণ আমদানিতে যে পরিমাণ পণ্যমূল্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সে পরিমাণ টাকা যথাযথ মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানিতে আরও বেশি টাকা অন্যান্য চ্যানেলে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যের চেয়ে শুল্কায়নযোগ্য মূল্যে যতটুকু বেশি সেই পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে, জব্দ করা মদের বাজারমূল্য হিসাবে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে সেটি তদন্ত সাপেক্ষে নিশ্চিত করা যাবে।’
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে জব্দ হওয়া দুই চালান এবং বন্দরে এক চালানে আমদানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করেছে। এতে তারা যে পরিমাণ পণ্য ঘোষণা দিয়েছে বলে জানান। তবে পরের দুটি চালানে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না হওয়ায় ঘোষিত মূল্য পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। অন্যদিকে, ২২ জুলাই রাতে দুই কনটেইনার মদ জব্দের ঘটনায় তিনজনকে আটক করে র্যাব। ২৪ জুলাই (রোববার) রাতে আটক তিনজনসহ ১১ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে র্যাব-১১ এর উপপরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে সোনারগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেন।
গ্রেফতাররা হলো- মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার ষোলঘরের ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামের ছেলে আবদুল আহাদ (২২), তার দুই সহযোগী একই জেলার লৌহজং থানার নাগেরহাটের মৃত শেখ জয়নুল আবেদীনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৪) ও শ্রীনগরের ষোল ঘর ভুইচিত্র এলাকায় মো. আক্কাস মোল্লার ছেলে মো. নাজমুল মোল্লা(২৩)। মামলার অন্য আসামিরা হলো, মো. আজিজুল ইসলাম (৫৭), মিজানুর রহমান আশিক (২৪), সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জাফর আহমেদ (৩৫), শামীম (৩২), রায়হান (৩৫), দুবাই প্রবাসী (অজ্ঞাত), দিপু (২৮) এবং বাদশা (৩২)।