গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন কমছে শিল্পখাতে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৩ পিএম, ২১ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:২০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
তীব্র জ্বালানি সংকটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে শিল্পগুলো। মূলত যেসব শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় বেশি- ইস্পাত, সার ও সিরামিক সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় আরও যেসব শিল্প ধাক্কা খেয়েছে সেগুলোর মধ্যে জাহাজ ভাঙা ও পোশাকও রয়েছে। বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং গ্যাসের চাপ কম থাকায় বেশিরভাগ কারখানার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু শিল্প বিকল্প জ্বালানির উৎস ব্যবহার করে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। রফতানিকারকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না।
ইস্পাত শিল্প : গ্যাসের সংকটে ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানা চালাতে গিয়ে সক্ষমতার অন্তত ৩০ শতাংশ বন্ধ রেখেছে দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসআরএম গ্রুপ। এতে উৎপাদন খরচও ২৫-৩০ শতাংশ বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও তাদের হাতে নেই।
বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, দৈনিক ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে তারা পাচ্ছেন ১১০ মেগাওয়াট। তপন সেনগুপ্ত আরও বলেন, এ অবস্থায় উৎপাদন কমিয়ে কারখানা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ আমরা এখনো কল্পনাও করতে পারছি না। ক্রেতাদের অর্ডার সময়মতো দিতে না পারলে বাজার হারানোর শঙ্কা তো রয়েছেই। বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে দেশের ইস্পাত খাতের আরও দুই জায়ান্ট কেএসআরএম ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপও উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না।
কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের কারখানাগুলোতে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের মোস্তফা হাকিম গ্রুপের দুটি ইস্পাত কারখানা গোল্ডেন ইস্পাত ও এইচ এম স্টিল। কারখানা দুটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৬০০ টনের মতো মাইল্ড স্টিল (এমএস) রড উৎপাদন হয়। এই কারখানা দুটিও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে কারখানা দুটির উৎপাদন আগের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিতে হয়েছে। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন থেকে নেমে এসেছে ১ হাজার ১০০ মেট্রিক টনে। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক সরওয়ার আলম বলেন, ইস্পাত শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রয়োজন। এসব কাঁচামালের সংকট হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যন্ত্রপাতির অবচয় খরচ বাড়ে। এছাড়া শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন গুনতে হয়। পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে তাদের ইস্পাত ও গ্লাস কারখানাগুলোতে সমস্যা হচ্ছে। তারা ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, এই লোডশেডিংয়ের বাস্তব প্রভাব সম্পর্কে বলতে আরও সময় লাগবে। তবে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তবে সরকার যেহেতু শিল্পকারখানাগুলোকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের চেষ্টা করছে, তাই দ্রুত অবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সিরামিক শিল্প : একইভাবে গ্যাসের পরিবর্তে ডিজেল দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে গিয়ে দেশের শীর্ষ সিরামিক উৎপাদনকারী আরএকে সিরামিকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ। আরএকে সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, সিরামিক শিল্প নিজেদের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু চলমান গ্যাস–সংকটের কারণে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ না থাকায় টাইলস উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি। দেশের ৩০টি সিরামিক কারখানায় মোট সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে জানিয়ে শহীদুল ইসলাম বলেন, এ অবস্থায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে শিল্পটি দীর্ঘ সময়ের জন্য অনিশ্চয়তায় পড়বে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে দেশের বৃহত্তম টাইলস উৎপাদনকারী গ্রেট ওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বাংলাদেশ সিরামিকস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও গ্রেট ওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুল হুদা বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় জুন মাসে আমরা ১৫ দিন কারখানা বন্ধ রেখেছি। এখন কোনোমতে সিঙ্গেল শিফটে কারখানা চালাচ্ছি। এখন নিয়মিত এক ঘণ্টার লোডশেডিং তাদের আরও বেশি সংকটে ফেলবে বলে জানান তিনি।
বন্ধ যমুনা ও চিটাগং ফার্টিলাইজার কারখানা : গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল) প্রায় এক মাস ধরে সার উৎপাদন করতে পারছে না। আগামী তিন মাস কারখানাটি চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না কারখানাটির কর্মকর্তারা। বন্ধ হয়ে গেছে চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডও (সিইউএফএল)। শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানিও এই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলো চালু রাখতে হলে ৩১৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু কারখানাগুলো পাচ্ছে ১৫৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। এ কারণে সবগুলো কারখানার উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান বলেন, মাসখানেক ধরে গ্যাসের সংকটের কারণে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে জানিয়েছি, চিঠি দিয়েছি, বারবার মিটিং করছি। কিন্তু এখনো এর কোনো সমাধান হয়নি। যমুনা ও চট্টগ্রাম সার কারখানা দুটিতে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইউরিয়া সার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকও।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, কারখানা দুটি চালু করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ইউরিয়া সার আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এবং সারে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়বে। এছাড়া, গ্যাস সংকটের কারণে সার কারখানা বন্ধ হলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।
আরএমজি : সমস্যায় পড়েছে শীর্ষ রফতানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও। বিদ্যুতের ঘাটতিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে পোশাক কারখানায়। কর্ণফুলী ইপিজেডের ফিনেস অ্যপারেলস। চলতি বছর ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ফর্মাল পোশাক রফতানির টার্গেট ছিলে তাদের। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানটির পোশাক উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। রফতানিমুখী পোশাক কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের সর্বোচ্চ তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত জেনারেটর চালু রাখতে হচ্ছে। এতে সর্বনিম্ন ৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে আমাদের প্রায় ১১ শতাংশ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ও আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, তীব্র লোডশেডিংয়ে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। যদি বিদ্যুতের এমন বেহাল দশা হয় তাহলে শুধু ব্যবসায়ীরা না, পুরো দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সমস্যার কথা জানিয়ে আমরা ইতিমধ্যে পিডিবিকে চিঠি দিয়েছি।
নর্টেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ইস্তাহাক আহমেদ সৈকত বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকে বলে তিনি দাবি করেন।
সৈকত বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহও স্থিতিশীল নয়। এতে টেক্সটাইল ও স্পিনিং ইউনিট চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে সময়মতো শিপমেন্টও কঠিন হয়ে যাবে। এর ফলে ক্রেতারা আস্থা হারাতে পারে বলেও জানান তিনি। সীমিত পরিসরে ডিজেল জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও গ্যাস সংকটের মধ্যেও উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান রাকিব। তবে এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে বলে জানান তিনি। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন শীর্ষস্থানীয় স্পিনিং মিল মালিক বলেছেন, তাদের ১৫ পিএসআই-তে (পাউন্ডস পার ইঞ্চ) গ্যাসের চাপ দরকার, কিন্তু ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকে গ্যাসের চাপ ১.৮ পিএসআই থেকে ৩.২ পিএসআইয়ের মধ্যে রয়েছে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন।
জাহাজভাঙা শিল্প : পুরোনো জাহাজ থেকে প্রতি টন স্ক্র্যাপ কাটতে গড়ে ২ কেজি পরিমাণ এলপিজি গ্যাস প্রয়োজন হয়। চলমান গ্যাস সংকটে দেশের এই ভারী শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাজও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, জাহাজ কাটার প্রধান জ্বালানি এলপিজি গ্যাস। বিশ্বব্যাপী সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার এলপিজি গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এলপিজি আমদানি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে জাহাজভাঙা খাতের কার্যক্রম পুরো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এই বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।