বেতন-ভাতার নামে ১০ মাসে ৯ কোটি ৩৭ ডলার নিজ দেশে পাঠিয়েছে বিদেশিকর্মীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৩৯ পিএম, ৫ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:১২ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা কষ্টার্জিত অর্থ দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠাচ্ছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশিকর্মীরা বেতন-ভাতাবাবদ বিশাল অঙ্কের অর্থ নিজ নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে বিদেশিকর্মীরা বেতন-ভাতা হিসাবে ৯৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন (নয় কোটি ৩৭ লাখ) ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ৮৭১ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে গেছে ৯৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে গেছে ৯৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর এমন চিত্র পেলেও ‘বাস্তবচিত্র কিন্তু ভিন্ন’, বলছে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে অবৈধ পথে প্রায় ২০ গুণ বেশি অর্থ বাংলাদেশ থেকে বিদেশিকর্মীদের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর বড় একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। যার সঠিক হিসাব নেই কারও কাছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে ২১ খাতে ৪৪ দেশের দুই লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এর মধ্যে কর দিচ্ছেন মাত্র নয় হাজার ৫০০ জন। বাকি দুই লাখ ৪১ হাজার কর্মী অবৈধ বলে বিবেচিত। তারা বেতন-ভাতার নামে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ পাচার করছেন।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তথ্য এসেছে, সেটা কিন্তু বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। আমাদের দেখতে হবে বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে কত টাকা আয় করছেন, আর এর কত শতাংশ ব্যাংকিং চ্যানেলে যাচ্ছে। এটা মূল বিষয়। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বেতন দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৩.৬ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু তাদের প্রকৃত বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার। এছাড়া প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা পদে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলারের স্থলে ২.৫ থেকে ৩ হাজার ডলার দেখানো হচ্ছে। কমপ্লায়েন্স বা সোশ্যাল অডিটর পদে ৯.৫ থেকে ১১ হাজার ডলারের জায়গায় ৩ থেকে ৩.৫ হাজার ডলার, জেনারেল ম্যানেজার পদে ৬ থেকে ৮ হাজারের স্থলে ১.৮ থেকে ২.৫ হাজার ডলার এবং হেড অব ডায়িং পদে ৫ থেকে ৭ হাজারের স্থলে ১.৫ থেকে ২ হাজার ডলার বেতন দেখানো হচ্ছে। ‘সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ পাচার হচ্ছে। বৈধ প্রক্রিয়ায় পাঠানো এক বিষয়। আর অবৈধ পন্থায় অর্থাৎ হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পাঠানো আলাদা বিষয়। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দ্বিতীয় মাধ্যমে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।’
পাচার ঠেকাতে কী করা উঠিত-জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যারা বিদেশিকর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছেন তাদের সচেতন হতে হবে। কারণ, তারা জানেন ওই কর্মীকে কত টাকা দেয়া হচ্ছে এবং তারা বৈধ পথে কত টাকা পাঠাচ্ছেন। এছাড়া তাদের বেতনের তথ্য যদি বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ এজেন্সি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয় তাহলে বিষয়টি চিহ্নিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের স্বচ্ছতার বিষয়টি চলে আসে। তারা যদি বৈধ প্রক্রিয়ায় বিষয়গুলো জানায় তাহলে পাচার রোধ করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কাজের জন্য আসা বেশিরভাগ লোকই অবৈধভাবে আসেন। অনেকে ভ্রমণ ভিসায় এসে কাজ করেন। তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি যারা বৈধভাবে কাজ করছেন তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব এনবিআরকে স্বচ্ছতার সঙ্গে দিতে হবে। তাহলে অর্থপাচার কমবে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স যাওয়ার হার বাড়বে— বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে মোট ২১ খাতে ৪৪ দেশের শ্রমিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভারতের। সরকারি হিসাবে দেশটির ৩০ হাজারের বেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। এরপর চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়ার নাগরিকরা রয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। তাদের ন্যূনতম মাসিক বেতন দেড় হাজার মার্কিন ডলার। বিদেশিকর্মীদের মোট বার্ষিক আয় চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশে নিয়ে যায় তিন দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
টিআইবি বলছে, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে বিদেশিকর্মী নিয়োগ দিতে গেলে জনপ্রতি নিয়মবহির্ভূতভাবে ২৩ থেকে ৩৪ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। বৈধভাবে বিদেশিকর্মী আনা হলে আটটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। অবৈধভাবে আনা হলে তিন ধাপেই নিয়োগ চক্র শেষ হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই পর্যটক ভিসায় এসে কাজ করেন। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির দাবি, বিদেশিদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রেও তথ্য গোপন করছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। টিআইবি বলছে, প্রাথমিকভাবে ১০ ক্যাটাগরিতে চাকরি করছেন বিদেশিরা। এর মধ্যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বেতন দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৩.৬ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু তাদের প্রকৃত বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার। এছাড়া প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা পদে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলারের স্থলে ২.৫ থেকে ৩ হাজার ডলার দেখানো হচ্ছে। কমপ্লায়েন্স বা সোশ্যাল অডিটর পদে ৯.৫ থেকে ১১ হাজার ডলারের জায়গায় ৩ থেকে ৩.৫ হাজার ডলার, জেনারেল ম্যানেজার পদে ৬ থেকে ৮ হাজারের স্থলে ১.৮ থেকে ২.৫ হাজার ডলার এবং হেড অব ডায়িং পদে ৫ থেকে ৭ হাজারের স্থলে ১.৫ থেকে ২ হাজার ডলার বেতন দেখানো হচ্ছে। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিদেশিকর্মীদের যোগসাজশে এমনটি করা হচ্ছে।
‘স্থানীয় বাংলাদেশিরা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বিদেশিদের থাকার সুব্যবস্থা করে দিচ্ছেন’ উল্লেখ করে টিআইবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট আট সংস্থাকে ২৩ থেকে ৩৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। আট ধরনের কাগজপত্র ঠিক করতেই নিয়মবহির্ভূত এ আর্থিক লেনদেন করতে হচ্ছে। ভিসার সুপারিশপত্র, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা সংগ্রহ, বিদেশি নাগরিক নিবন্ধন, কাজের অনুমতির জন্য আবেদন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র (এসবি পুলিশ), নিরাপত্তা ছাড়পত্র (জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা), নিরাপত্তা ছাড়পত্র (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি এই আট ধরনের কাগজপত্র সম্পন্ন করতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সোয়া চার হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনে।
এদিকে, প্রণোদনা বাড়ানোসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত ৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের রেট ব্যাংকের চেয়ে খোলা বাজারে বেশি। তখন বৈধ চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেশি আসে। এখন এক ডলার রেমিট্যান্সের বিপরীতে ব্যাংক ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা দিচ্ছে। সঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। সবমিলিয়ে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু খোলা বাজারে ডলার ৯৮ থেকে ৯৯ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স এলে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, এ কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।
রেমিট্যান্স কমার বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, কয়েকটি কারণে রেমিট্যান্স কমছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, গত বছর যে রেমিট্যান্স এসেছিল, তা ছিল আর্টিফিশিয়াল (কৃত্রিম)। অর্থাৎ যেসব অর্থ হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে আসত, গত বছর করোনার কারণে বিশ্বে যাতায়াত বন্ধ থাকায় ওই অর্থটা ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। ফলে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে। এখন আবার যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। ওই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন আর আসছে না। তাই রেমিট্যান্স কমেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ, আগস্টে ১৮১ কোটি, সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ, অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ, নভেম্বর ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ, ডিসেম্বরে ১৬৩ কোটি এবং জানুয়ারিতে এসেছে ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আসে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ, মার্চে পাঠিয়েছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ, এপ্রিলে ২০১ কোটি ৮ লাখ, মে মাসে ১৮৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এসেছে এবং সর্বশেষ জুন মাসে এসেছে ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার।