ভবনের কাজ শেষ না করেই ৭০ লাখ টাকা তুলে নিলেন ঠিকাদার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০১ পিএম, ২৬ জুন,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪০ পিএম, ১২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জে ১১৪ নং প্রগতি বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের কাজ তিন বছরেও শেষ হয়নি। এতে পাঠদানে শিক্ষকদের যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের বসতে হয় গাদাগাদি করে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকল্পে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৮৯ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৯ সালে জিহাদ ট্রেডাস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজটি পায়। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়। সেখানে ভবন হস্তান্তরের তারিখ ছিল ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর। কিন্তু তিন বছর পার হলেও ভবনের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৮৯ টাকার মধ্যে ৭০ লাখ ২৩ হাজার ৪১৪ টাকা ঠিকাদার উত্তোলন করেছে।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার আরশি নগর ইউনিয়নের সিকদার কান্দি গ্রামের ১১৪ নং প্রগতি বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। সেই বছর টিনের ঘর ভেঙে সেখানে তিন কক্ষের একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। তিনটি কক্ষের একটি অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাকি দুটি কক্ষে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থী রয়েছে ১৫০ জন। এতে ক্লাস নিতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হয়। ২০১৮ সালে বিদ্যালয়ের একটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে এলজিইডি। তিন বছর আগে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বেশ কয়েকবার নিম্নমানের কাজ করার জন্য স্থানীয়ভাবে বাধাও দেয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো প্রতিকার হয়নি। ঠিকাদার কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে গেছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিন রুম একটি ভবন রয়েছে বিদ্যালয়ে। পাশেই বিদ্যালয়ের অসমাপ্ত নতুন ভবন পড়ে আছে। তিন বছর ধরে এই ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে। নতুন ভবনেরও বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় ইট সরে গেছে। কোথাও আবার রড বের হয়ে আছে। ভবনে যে রড ব্যবহার করার কথা ছিল, তা ব্যবহার করা হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা। সাইড দেয়ালে রডের ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেখানে নেই রড। ভবনটির নির্মাণের শুরু থেকেই অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন তারা।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলে, আমাদের বিদ্যালয়ে বৃষ্টি হলে চাল দিয়ে পানি পড়ে বই-খাতা সব ভিজে যায়। গরমের মধ্যে ক্লাস রুমে বসা যায় না। তখন গাছতলায় গিয়ে ক্লাস করি। শ্রেণিকক্ষ না থাকায় শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের বারান্দায় মাদুর পেতে বসতে হয়।
স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবিবা বলে, আমাগো টিনের ঘরের ক্লাসরুম অনেক ছোট। আমাদের গরমের সময় অনেক গরম লাগে। আবার বৃষ্টিতে বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। তিন বছর ধরে বিল্ডিং করতে আছে কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা ক্লাস করতে যেতে পারছি না। বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে ক্লাস করতে পারতাম। সহকারী শিক্ষক জান্নাত বলেন, শ্রেণিকক্ষ না থাকায় শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের বারান্দায় মাদুর পেতে পাঠ দিতে হয়। এখন বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় ক্লাস ওয়ানের সঙ্গে তাদের বসাতে হয়। বাচ্চাদের জন্য খেলনা ব্যবহার করতে পারি না। আমাদের জরাজীর্ণ ভবন হওয়ায় প্রতিবছর ছাত্র-ছাত্রী কমে পাশের স্কুলে চলে যাচ্ছে।
প্রগতি বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে বিদ্যালয়ের। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করছিল। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ। বেশ কয়েকবার খারাপ মালামাল দিয়ে কাজ করার কারণে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মালামাল এনে আবার নতুন করা কাজ করে। কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর কাজ করেননি। এখন অর্ধেক কাজ করে ফেলে রেখেছে ঠিকাদার। তিন বছর ধরে কাজ বন্ধ। এলজিইডিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, নির্মাণকাজ শেষ না করেই তিনি কাজের ৭০ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করে ফেলেছেন। এখন ভবন নির্মাণ করে দিতে ঠিকাদার নানা ধরনের টালবাহানা করছেন। ফোন দিলে আসছি আসব বলে খালি ঘোরায়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রায় সব টাকা দেওয়া হলো কীভাবে? আমার থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে টাকা উঠাতে হলে। কিন্তু একবারও টাকা তোলার জন্য প্রত্যয়নপত্র নেয়নি। কীভাবে এই টাকা উঠল আমি জানি না। এলজিইডি অফিসে গেলে তারা আমাকে বলে, কাজ হয়ে যাবে। আপনার আসা লাগবে না।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুরেশ রায় বলেন, আমি বেশ কয়েকবার ইউএনও অফিসে গিয়েছিলাম কাজটি কেন করছে না তা জানতে। তারা করবে বলে খালি ঘোরাচ্ছে। কিন্তু করছে না।
এ বিষয়ে মেসার্স জিহাদ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জিয়াউর রহমান বলেন, ভবনটির বেশির ভাগ কাজই করা হয়েছে। আমি ভবনের কাজটি ডামুড্যার একজনকে দিয়ে করিয়েছিলাম। ওর ঝামেলার কারণে কাজটি ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। বাকি কাজ শিগগরিই শুরু করব। নির্মাণকাজ শেষ না করার আগেই কেন এত টাকা বিল দেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী অনুপম চক্রবর্তী বলেন, আমি নতুন এসেছি। বিষয়টি জানার পর ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে বলছি দ্রুত কাজ শেষ করতে। বিষয়টি খোঁজখবর নিচ্ছি, যাতে ভবনটি শিগগিরই শিক্ষার্থীরা নতুন ভবনে ক্লাস করতে পারে।