১৫ ব্যাংকের ভ্যাট ফাঁকি, এনবিআরের শুনানিতে তলব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৮ পিএম, ২৩ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:২৯ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয় বন্ড, ওয়েজ আর্নার বন্ড ও প্রাইজবন্ড বিক্রয়ের বিপরীতে কমিশনের ক্ষেত্রে দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫টি ব্যাংকের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রি করা সরকারি বন্ডের বিপরীতে ১৫ ব্যাংকের মোট সাড়ে ৪ কোটি টাকার ভ্যাট অপরিশোধিত ছিল বলে দাবি এনবিআরের। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) নিজস্ব তদন্তে বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে বকেয়া ভ্যাটের বিষয়ে নিশ্চিত হয়। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি ১৫ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর পাঠানো চিঠিতে ব্যাংকের প্রতিনিধি পাঠিয়ে শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছে ভ্যাট বিভাগ। গত ১৬ জুন এলটিইউর ভ্যাট বিভাগের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী সই করা চিঠিতে প্রতিটি ব্যাংকের ন্যূনতম ডিএমডি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ২৩ জুন বিকেল ৩টায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ব্যাংকগুলো হলো, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংক লিমিটেড, এইচএসবিসি ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, দি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড ও আরব বাংলাদেশ (এবি ব্যাংক) লিমিটেড। যদিও বকেয়া বা ফাঁকিকৃত ভ্যাটের বিষয়ে একমত নয় ব্যাংকগুলো। তাদের দাবি, প্রকৃতপক্ষে কোনো ভ্যাট বকেয়া নেই। ভ্যাট পরিশোধের চালান রয়েছে তাদের কাছে। হয়ত এলটিইউর ভ্যাট বিভাগের কাছে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি রয়েছে। যেমনটা বলছিলেন সাউথ ইস্ট ব্যাংকের চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার রাশেদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমরা সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কমিশন নিয়ে থাকি। কমিশনের ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য রয়েছে। সেই ভ্যাট আমরা ইতিমধ্যে পরিশোধ করেছি। যার চালানসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আমাদের কাছে রয়েছে। আগামীকাল শুনানিতে তা দাখিল করব। এনবিআরের দাবি ঠিক আছে, তবে এখানে তথ্যের গ্যাপ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে ২০১৭ সালের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ভ্যাট কেটে আমাদের কমিশন দিয়ে থাকে। কিন্তু আগে আমরা পরিশোধ করেছি। সেটা পরিশোধ হয়েছে কি না সেজন্যই মূলত তারা চিঠি দিয়েছে। প্রায় একই বক্তব্য দিলেন ব্র্যাংক ব্যাংকের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ইকরামুল কবীর।
তিনি বলেন, আমাদের কোনো গাফলতি নেই। আগামীকালের শুনানিতে আমরা আমাদের কাগজপত্র দাখিল করব। আমাদের কোনো ভ্যাট বকেয়া নেই। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো গাফলতি নেই। আগামীকাল কাগজপত্রসহ শুনানিতে আমাদের ভ্যাট বিভাগের একজন প্রতিনিধি যাবেন। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংকগুলোর এমডি ও জনসংযোগ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যেমন, জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ সালাম আজাদ, ডাচ বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম, ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও জবাব পাওয়া যায়নি। বিষয়টি জানা নেই, তাই বক্তব্য দিতে রাজি হননি প্রাইম ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম। ঢাকা ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো জবাব দেননি। এছাড়া অন্যান্য কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত ১৬ জুন ব্যাংকগুলোর এমডি বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বকেয়া ভ্যাট সংক্রান্ত তথ্য জানতে চলতি বছরের ২৬ মে প্রথম পত্রের মাধ্যমে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয়বন্ড, ওয়েজ আর্নার বন্ড, প্রাইজবন্ড বিক্রয়ের বিপরীতে কমিশনের তথ্য চাওয়া হয়। এরপর চলতি মাসের ১ জুন একই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে কমিশনের তথ্য দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে গত ৯ জুন অপর এক চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কমিশনের ওপর ভ্যাট এক্সক্লুসিভ না ইনক্লুসিভ (ভ্যাট ইনক্লুসিভ অর্থাৎ মূল্যের মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত এবং ভ্যাট এক্সক্লুসিভ অর্থাৎ মূল্যের সঙ্গে পরে ভ্যাট যুক্ত করা হয়) হবে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। গত ১৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক লিখিতভাবে জানায় ব্যাংকের অপরোশিত মূসক বা ভ্যাটের তথ্যের হিসাবে প্রযোজ্য মূসক এক্সক্লুসিভ করে প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রদত্ত নির্দেশনানুযায়ী প্রযোজ্য মূসক ইনক্লুসিভ হারে নির্ধারণ করার কথা বলা রয়েছে। সে মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ ২০১৫-১৬ হতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তফসিলি ১৫টি ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয় বন্ড ও প্রাইজবন্ড বিক্রয়ের বিপরীতে প্রাপ্ত কমিশনের ক্ষেত্রে মোট ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬৬ টাকার ভ্যাট অপরিশোধিত রয়েছে বলে মনে ভ্যাট বিভাগ।
পৃথক পৃথক পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, অপরিশোধিত ওই ভ্যাট কেন দাবি করা হবে না সেই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ২৩ জুন শুনানির জন্য উপযুক্ত কাগজপত্রসহ ডিএমডি পদ মর্যাদার একজন প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছ। ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে বিবরণে জানা যায়, ২০১৫-১৬ হতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয় বন্ড, ওয়েজ অনার্স বন্ড, প্রাইজ বন্ড বিক্রয়ের বিপরীতে কমিশনের ওপর অপরিশোধিত বা ফাঁকিকৃত ভ্যাটের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেডের ৮৯ লাখ ২৯ হাজার ১৫৮ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৬৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৩৮ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডা ব্যাংকের ৫৮ লাখ ৭ হাজার ৬৭১ টাকা, এবি ব্যাংকের ৪৯ লাখ ৪৮ হাজার ৬৪৭ টাকা, ব্র্যাংক ব্যাংক লিমিটেডের ৪২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০ টাকা, উত্তরা ব্যাংকের ২২ লাখ ৭২ হাজার ৪২১ টাকা, ডাচ বাংলা ব্যাংকের ২২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৯ টাকা, সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ১৮ লাখ ১১ হাজার ৮৫৫ টাকা, পূবালী ব্যাংকের ১৭ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬০ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৬১৯ টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ১৩ লাখ ২৫ হাজার ২৬১ টাকা, প্রাইম ব্যাংকের ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৯৫০ টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ১১ লাখ ২০ হাজার ৮৭২ টাকা, এইচএসবিসি ব্যাংকের ৮ লাখ ৫ হাজার ৬৭৩ টাকা এবং দি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের ২ লাখ ৭০ হাজার ৮৫২ টাকার। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬৬ টাকার অপরিশোধিত ভ্যাটের প্রমাণ পেয়েছে এলটিইউ বিভাগ। এ বিষয়ে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।