ঊর্ধ্বমুখী ডলারের দাম : নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০৫ পিএম, ১৯ মে,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:২২ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দেশের বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরইমধ্যে দেশের মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল। মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক গেল দুই মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে। এতে আমদানি করা পণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার কারণে দেশের পুরো বাজারেই দ্রব্যমূল্যর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৮৭ দশমিক ৫ টাকা। সোমবার (১৬ মে) দেশের ইতিহাসে টাকার মান একদিনে সর্বোচ্চ দশমিক ৮০ টাকা অবমূল্যায়ন করা হয়। খোলাবাজারে টাকার বিপরীতের ডলারের দাম ১০০ পার করলেও একদিনের মাথায় তা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। বর্তমানে প্রতি ডলার ১০০ বা তার নিচে বিক্রি হচ্ছে। তবে এতেও পরিস্থিতি তেমন একটা স্থিতিশীল হয়নি। দেশের ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এখনও ৯৫ টাকার বেশি দামে আনছে ও রফতানি বিল নগদায়ন করছে। তবে যেসব ব্যাংক ভালো দামে প্রবাসী আয় দিচ্ছে, সেসব ব্যাংক প্রবাসী আয় বেশি পাচ্ছে। একই অবস্থা রফতানি বিল নগদায়নেরও। যেসব ব্যাংক রফতানি নগদায়নে বেশি দাম দিচ্ছে, রফতানিকারকরা সেসব ব্যাংকেই নগদায়ন করতে যাচ্ছেন। তবে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনে তাদের দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতি ডলারে তাদের ৯৬ থেকে ৯৭ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এদিকে বর্তমানে পণ্য আমদানির জন্য যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হচ্ছে, তার বিপরীতে রফতানি আয় ও প্রবাসী আয় আসছে না। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ। অনেক ভোগ্যপণ্য আমরা বাইরে থেকে আমদানি করে থাকি। বিশ্ববাজারে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। করোনা অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া এমন কিছু ভোগ্যপণ্য রয়েছে, যেগুলো রাশিয়া সারা বিশ্বে সরবরাহ করে থাকে। এর জন্য আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যেহেতু বেশিরভাগ পণ্যে লেনদেনই ডলারের মাধ্যমে হয়ে থাকে, সেহেতু ডলারের চাহিদাও বেড়ে গেছে। তাই দেশীয় বাজারে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রফতানি ও প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে আমাদের দেশে ডলার আসে। সাম্প্রতিক প্রবাসী আয়ও নিম্নমুখী। অপরদিকে রফতানি আয় বাড়লেও- যেমন তৈরি পোশাক খাত, সেখানে অনেক কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। সুতরাং আমরা যে পরিমাণ আমদানি করছি, তা রফতানি আয় ও প্রবাসী আয় দিয়েও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এখানে একটি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এর কারণে একটি ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানি করতে আমদানিকারকদের বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিকারকদের বিলাসপণ্য আমদানি করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ সফর বাতিল করেছে সরকার।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি দায় মেটাতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এতে রিজার্ভ কমে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা দেশের জন্য আশঙ্কারই বার্তা দেয়। গ্রামীণফোনের দেশের বাইরে ১ কোটি ১০ লাখ ডলার লভ্যাংশ পাঠানোর কথা উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, আমদানি ব্যয় ডলারের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হয়। এখন দেশের রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার, এটি ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। গ্রামীণফোন তো আমাদের এখান থেকে ডলার কিনেই নিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরও বেশি ডলার দেশের বাইরে চলে যাবে। যত অর্থ দেশের বাইরে যাবে, দেশের রিজার্ভে ততবেশি চাপ পড়বে।
এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশ রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি হয়ে থাকে। ফলে আমদানি খরচ আরও বাড়বে। দেশে যে পরিমাণ অর্থ রফতানি করে আয় হচ্ছে, তার তুলনায় পণ্য আমদানিতে বেশি অর্থ ব্যয় হবে। যার প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যে। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে অস্থির তেলের বাজার। যার প্রভাবে প্রতিনিয়তই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। প্রায় সব পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে ইতোমধ্যে চাল, ডাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গমের দাম বেড়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় দেশের বাজারে বাড়ছে গমের দাম। এ বিষয়ে ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশ সরকারিভাবে গম আমদানি করতে পারলেও, যেহেতু ভারত সরকারেরও কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, অনেক সময় টাকা থাকা সত্ত্বেও গম আমদানি করা যাবে না। এ সুযোগেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। গমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে।
টাকার মান কমায় ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। যা নিম্ন আয়ের মানুষ, এমনকি মধ্যবিত্তদের জন্যও অসহনীয় হয়ে উঠবে। টাকা দিয়ে ডলার কিনে যেসব বৈদেশিক লেনদেন করা হয়, সেক্ষেত্রে গুনতে হবে বাড়তি খরচ। যেমন- শিক্ষা ব্যয় ও চিকিৎসা ব্যয়। এছাড়া বিমানের টিকিট আর বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে গেছে। ফলে বিদেশগামী যাত্রী ও পর্যটকদের নতুন করে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি শিল্প স্থাপনে ব্যয় বাড়বে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়েছে। যা পরিশেষে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গেই যোগ হয়। বলাবাহুল্য, বেশি দামে পণ্য আমদানি হলে, তা দেশের বাজারে বেশি দামেই বিক্রি হবে। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল বেশি দামে আমদানি করলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ফলে দামও বাড়বে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, আমদানি করা পণ্য বা যেসব পণ্যের কাঁচামাল দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়, সেসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। যেমন- সিমেন্ট। তবে এ নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই জানিয়ে অর্থনীতিবিদ আবু ইউসুফ বলেন, আমাদের রিজার্ভের ভিত্তি, যেটি সাধারণত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো থাকার কথা, সেটি এখন পর্যন্ত ৫ মাসের মতো রয়েছে। যা এক সময় ৮ মাসেরও ছিল।
এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, খোলাবাজার ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে পার্থক্য হচ্ছে ৮ থেকে ৯ টাকার। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ ৬১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল।