হালকা শিল্পে নির্ভরশীল ৮০ লাখ মানুষ, বাড়ছে রফতানি আয়
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:২১ পিএম, ৭ মে,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:৪০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বাংলাদেশে তৈরি বাইসাইকেলের কদর এখন বিশ্বজোড়া। পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা দামের বাইসাইকেলও তৈরি হচ্ছে দেশে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সরকারি বাইসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৬ সালে কিনে নেয় মেঘনা গ্রুপ। বছর তিনেক পর ১৯৯৯ সাল থেকে এ শিল্পপণ্যটির রফতানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বাইসাইকেল রফতানি হচ্ছে জার্মানি, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ইতালি ও বুলগেরিয়ার মতো দেশগুলোতে। বর্তমানে রেড, ফেরাল ও ইনিগো ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ইউরোপ ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কঙ্গো, গ্যাবন ও আইভরিকোস্টে দেশি সাইকেল রফতানি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাইসাইকেল রফতানি থেকে এসেছে এক হাজার ১২১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৪০ হাজারের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এ খাত ঘিরে চলমান, যেখানে সরাসরি নির্ভরশীল প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নিবন্ধিত চারশ উদ্যোক্তা সারাদেশে হালকা প্রকৌশল ও সংশ্লিষ্ট শিল্পনির্ভর কারখানা গড়ে তুলেছেন। হালকা শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব শিল্প লৌহজাত ঢালাই, বাইসাইকেল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, প্রকৌশল যন্ত্র, পরিবাহী তার, মরিচাহীন ইস্পাত সামগ্রী উৎপাদন করছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে এ খাত থেকে রফতানি আয় বেড়ে ৫১ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতে ৩১ দশমিক ১, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৯, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৭ দশমিক ৫, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৭ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় আসে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আসে ৪৪ দশমিক ৭ কোটি ডলার। ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের উন্নয়ন ও ই-ওয়েস্ট প্রক্রিয়াকরণের সুবিধাদি সৃষ্ট’ প্রকল্পের মাধ্যমে এ খাত আরও এগিয়ে নিতে চায় সরকার। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দেশের হালকা ও মাঝারি প্রকৌশল খাতের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। চট্টগ্রামে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নয়ন কেন্দ্র এবং রাজশাহী ও সাভার চামড়া গবেষণা কেন্দ্রে ম্যাটেরিয়ালস কেন্দ্র স্থাপন করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
এছাড়া ঢাকা ক্যাম্পাসে ম্যাটেরিয়ালস কেন্দ্র এবং ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প কারখানার মাধ্যমে উৎপাদিত কন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল (স্টিল, কংক্রিট, সিমেন্ট ইত্যাদি), লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের উৎপাদিত পণ্য (স্পেয়ার পার্টস, ইত্যাদি) এবং ইলেকট্রিক্যাল ম্যাটেরিয়ালের (ক্যাবলস্, ইনস্যুলেটর ইত্যাদি) মানোন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ এবং স্থাপন করা হবে যৌথ গবেষণা কেন্দ্র। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন হবে জুন ২০২৪ মেয়াদে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল গফুর জাগো নিউজকে বলেন, রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাইসাইকেল অনেক এগিয়ে গেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে পণ্যটি এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া লৌহজাত ঢালাই, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, প্রকৌশল যন্ত্র, পরিবাহী তার, মরিচাহীন ইস্পাত সামগ্রীও বিদেশে যাচ্ছে। এসব খাতে অনেক মানুষ জড়িত। তারা কীভাবে আরও উন্নয়ন করতে পারে কীভাবে তাদের আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এখন সম্ভাবনাময় খাত। আমরা চেষ্টা করছি এ খাতে আরও উন্নতি করার। সংশ্লিষ্টদের আরও সাপোর্ট দেওয়া হবে। এজন্যই প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।
বিসিএসআইআর সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাপী উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ম্যাটেরিয়ালস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন সর্বদাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানসম্পদ, সহজলভ্যতা এবং সুলভ পণ্য ও সেবার চাহিদা থেকেই মূলত শিল্পায়নের সূচনা হয়। শিল্পায়নের চালিকাশক্তি হলো উন্নত কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং সংশ্লিষ্ট সেবা, যা ম্যাটেরিয়াল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশের শিল্প এরই মধ্যে নিজস্ব উদ্যম আর প্রচেষ্টা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এ অবস্থাকে এগিয়ে নিতে ম্যাটেরিয়াল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে হতে হবে আরও সংহত। এজন্য প্রয়োজন কারিগরি সক্ষমতার উন্নয়নকারী একটি আধুনিক গবেষণাগার।
কোনো একটি দেশের শিল্পকারখানা সে দেশের রপ্তানি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- হালকা ও ভারী যন্ত্রপাতি তৈরি এবং যন্ত্রাংশের মেরামত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা সম্ভাবনার বিচারে আরও অনেক বাড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। হালকা প্রকৌশল খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢালাই, যন্ত্রাংশ, ডাইস ও মোল্ড, হালকা মেশিন, সুইচ, শেড, চ্যানেল, পরিবাহী তার, ফ্যান, বাইসাইকেল, ফিটিংস, কন্সট্রাকশন যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি, স্ট্যাবিলাইজার, কার্বন রড, পরিবহন যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন যন্ত্রাংশ, নাট-বল্টু, প্ল্যাস্টিক পণ্য, ধাতব ফার্নিচার, তৈজসপত্র, অগ্নিনির্বাপক, গ্যাস সিলিন্ডার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেশের কৃষি, খাদ্য, পাট ও টেক্সটাইল, কাগজ, সিমেন্ট, জাহাজ নির্মাণ, কেমিক্যাল, ওষুধ, গাড়ি, নৌ ও রেলওয়ে শিল্পের অন্তত ৫০ শতাংশ চাহিদা এ খাত মেটায়। রপ্তানি বিবেচনায় হালকা প্রকৌশল খাতের দুটি পণ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- বিদ্যুৎ পরিবাহী কপার তার এবং বাইসাইকেল। দেশীয় চাহিদার পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও এসব পণ্যের রয়েছে বিপুল চাহিদা। এছাড়াও ইলেকট্রিক্যাল খুচরা যন্ত্রাংশ যেমন- মিটার, ট্রান্সফরমার, কন্ডাক্টর ইত্যাদি উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সুনাম কুড়াচ্ছে। এসব শিল্পে ধাতব লোহা, অ্যালুমিনিয়াম এবং তামাজাতীয় পদার্থের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে গুণগত মান যাচাই এবং গবেষণা ও উন্নয়ন সেবার চাহিদা দরকার। বিএসআইআর বলছে, বাংলাদেশ সরকার হালকা প্রকৌশল খাতকে সামনে রেখে বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজধানীর আশপাশে ‘হালকা প্রকৌশল গুচ্ছগ্রাম’ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে গার্মেন্টস শিল্পের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এ হালকা প্রকৌশল খাত। এসব কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে এবং সংশ্লিষ্ট খাতের চলমান সমস্যা সমাধানে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা দরকার।
বাংলাদেশ ফরেন এইড ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে পরিচালিত এক গবেষণায় হালকা প্রকৌশল খাতের কিছু প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- চিহ্নিত সমস্যা: বৈদেশিক বৃহৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার, মানসম্পন্ন কাঁচামালের অভাব, আমদানি পণ্যের মান যাচাই সুবিধার স্বল্পতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত ও দৃশ্যমান মানের ঘাটতি লক্ষণীয়। এছাড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মান যাচাই করার জন্য স্বীকৃত গবেষণাগারের অভাব, সুস্থ বিনিয়োগের বিপরীতে বাজারদরের অসঙ্গতি রয়েছে। আছে দক্ষতার অভাব, কেন্দ্রীয় গবেষণা ও উন্নয়ন ঘাটতিও। লোহা ও ইস্পাত শিল্প: বাংলাদেশে ভারী প্রকৌশল শিল্প বলতে যা বোঝায় তার কার্যত একমাত্র উপস্থিতি লোহা ও ইস্পাত শিল্প। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে স্টিল রি-রোলিং মিল। দেশে প্রায় চারশ স্টিল রি-বোলিং মিল রয়েছে। এগুলোর মোট বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ টন। দেশে বার্ষিক স্টিল ব্যবহারের চাহিদা ২৭ লাখ টন। মিলগুলো বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন স্টিল উৎপাদন করে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। শুধু সরকারের বহুবিধ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পেই জাতীয় চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ স্টিল ব্যবহার হয়। দেশের টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ খাতের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমান মাথাপিছু স্টিল ব্যবহার মাত্র ২৫ কেজি, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যা প্রায় ২১৭ কেজি। ২০২২ সাল নাগাদ এটি ৫০ কেজিতে পৌঁছাতে পারে। শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব খাতের উন্নয়নে সরকারের আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেন সার্বিকভাবে হালকা শিল্প রপ্তানি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করে। আয় করে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার বৈদেশিক মুদ্রা।