ঢালাও সুদ মওকুফ, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪০ পিএম, ২১ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৫২ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ব্যাংক খাতে বাছবিচার ছাড়াই ঢালাওভাবে সুদ মওকুফের ঘটনা ঘটছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঢালাওভাবে সুদ মওকুফ সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে, গ্রাহকদের মাঝে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে অনাগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। যা ব্যাংকিং খাতে সার্বিক ঋণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এই কথাগুলো উল্লেখ করে আজ বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে ঢালাও সুদ মওকুফ বন্ধে একটি নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন এই নির্দেশনা : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমানতকারীদের জমা রাখা টাকা ফেরত দিতে পারে না, অথচ সেই ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকের ১৪ হাজার ৫৭৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব সময় বড় ঋণখেলাপিরা বেশি সুদ মওকুফ-সুবিধা পান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা এ সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকেন। এ প্রক্রিয়ার একটি কুফল হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সুদ মওকুফের যে সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এই সুবিধা পান না। এতে ব্যাংকের ক্ষতি। ব্যাংকের আয় কমে যায়।’
সুদ মওকুফ কাদের জন্য : বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে যেমন- ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদী ভাঙন, দুর্দশাজনিত কারণে বা বন্ধ প্রকল্প ইত্যাদি কারণে ব্যাংক কর্তৃক ঋণের সুদের সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ মওকুফ সুবিধা প্রদানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বর্ণিত বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন গ্রাহকের অনুকূলে প্রায়শই সুদ মওকুফ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
নতুন নির্দেশনায় যা বলা হয়েছে :
(ক) মূল ঋণ (আসল) মওকুফ করা যাবে না।
(খ) জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার ঋণের সুদ মওকুফ করা যাবে না।
(গ) ব্যাংকের আয় খাত বিকলন করে সুদ মওকুফ করা যাবে না।
(ঘ) ঋণের সুদ মওকুফ সুবিধা ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। তবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূল ঋণের সুদ মওকুফ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করা যাবে।
(ঙ) সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় আদায় নিশ্চিত করতে হবে। তবে, নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে তহবিল ব্যয় আদায় সংক্রান্ত শর্ত শিথিল করা যেতে পারে:
(১) তিন বছর যাবত বন্ধ রয়েছে এরূপ প্রকল্পের ক্ষেত্রে।
(২) ঋণের জামানত,সহজ জামানত, প্রকল্প সম্পত্তি এবং প্রকল্প উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রয় হতেও তহবিল ব্যয় আদায় করা সম্ভবপর না হলে।
(৩) পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে আইনগত ব্যবস্থাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পাওনা আদায় করা না গেলে।
(৪) ঋণগ্রহীতার মৃত্যু অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদী ভাঙন বা দুর্দশাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে।
(চ) ঙ -ধারায় বর্ণিত এক বা একাধিক কারণে তহবিল ব্যয় আদায়ের শর্ত শিথিল করার যৌক্তিকতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে হেড অব ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স (এইচআইসিসি) এর মতামত গ্রহণ করতে হবে।
(ছ) যেসব ঋণের ক্ষেত্রে আর্থিক বিবরণী প্রণয়নের আবশ্যকতা রয়েছে, সেসব ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ব্যাংক আবশ্যিকভাবে ঋণগ্রহীতার বিগত ৩ বছরের আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করবে। আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনায় বিবেচনাধীন সময়ের সামষ্টিক কর পরবর্তী নিট মুনাফা অথবা সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ওনার্স ইকুইটি ইতিবাচক পরিলক্ষিত হলে সুদ মওকুফ করা যাবে না।
(জ) সুদ মওকুফ করা হলে ব্যাংকের নিজস্ব আর্থিক অবস্থার ওপর কিরূপ প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা করতে হবে। সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো নিজস্ব মূলধন পর্যাপ্ততা, প্রফিটাবিলিটিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচক বিবেচনায় নিয়ে অধিক মাত্রায় ডিউ ডিলিজেন্স প্রয়োগ করবে।
(ঝ) ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ২৮ এর পরিপালন নিশ্চিতকরণসহ অন্য কোনও ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং তার পরিবারের সদস্যবর্গ বা পরিচালকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো কর্তৃক সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে এ সার্কুলারে বর্ণিত নির্দেশনাসহ সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে জারিকৃত নির্দেশনা পরিপালনীয় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ খাত/সময়ের জন্য সুদ মওকুফ সংক্রান্ত কোনও নির্দেশনা প্রদান করা হলে সে ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা পরিপালনীয় হবে। এ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে সুদ মওকুফ সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
সুদ মওকুফের ক্ষতি : সুদ মওকুফ সুবিধার কারণে ব্যাংকের নিট আয় এবং আমানতকারীদের সুদ আয় কমে যায়। এতে ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) কম হয়, পাশাপাশি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুদ মওকুফের সুবিধা খুব বেশি পান না।