খাতুনগঞ্জের তেল-চিনি-গুঁড়াদুধের বাজারে ফের অস্থিরতা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৬ পিএম, ২০ এপ্রিল,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:০৯ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সরকারি নানান পদক্ষেপেও অস্থিরতা কমছে না দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে হু হু করে বাড়ছে ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়াদুধের দাম। রোজা শুরুর পর থেকে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে প্রতি মণে ৭শ-৮শ টাকা। একইভাবে চিনির দাম বেড়েছে ২শ-৩শ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে ২৫ কেজি গুঁড়াদুধের দাম বেড়েছে প্রায় ছয় হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ভুল নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাতুনগঞ্জের বাজারে ইতিমধ্যে পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি ছয় হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। একইভাবে ছয় হাজার সাতশ টাকা উঠেছে সয়াবিন তেলের দাম। অথচ প্রতি মণ পাম অয়েল পাঁচ হাজার ১৮০ ও প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এর আগে ভোজ্যতেলের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। এরপর কয়েকদিন তেলের দাম কমলেও এখন হু হু করে বাড়ছে দাম। খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী আবু তাহের জানান, প্রতিদিনই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। মঙ্গলবার প্রতি মণ পাম অয়েল ছয় হাজার ৫০ টাকা এবং সয়াবিন ছয় হাজার ৭৫০ টাকা দর উঠেছে।
এদিকে সরকারি দরে সামান্য কিছু ভোজ্যতেল বিক্রি করলেও ডিও (ডেলিভারি অর্ডার), এসও (সেলস অর্ডার) নিয়ে মিলারদের নতুন কারসাজিতে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ডিও ব্যবসায়ী বলেন, বেশিরভাগ পাম অয়েল ব্যবহৃত হয় খাদ্যপণ্য তৈরিতে। অথচ খাতুনগঞ্জের খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারি দরে পাম অয়েল দিচ্ছেন না মিলাররা। এজন্য খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি দামে বাজার থেকে ডিও কিনে পাম অয়েল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মিলাররা কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন। বাজার থেকে ডিও কিনে মিলগেট থেকে তেল সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে বাজারের বেশি দামের ডিওগুলো কিনে প্রথমে মিলারদের কাছে জমা দিতে হচ্ছে। মিলাররা এসব ডিও জমা রেখে নতুন একটি এসও দিচ্ছেন, যেখানে সরকারি দর উল্লেখ রয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করারও সুযোগ নেই। অন্যদিকে সরকারি দরে যাদের পাম অয়েল সরবরাহ দেয়া হচ্ছে, তারাও কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন। খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, এখানে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ অভিযোগ তুললে তাকে পরের দিন থেকে আর কেউ মাল (পণ্য) দেবে না। সবাই মিলারদের ভয় করে। এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, এখন সরকারি দরে কিছু বড় মুদি দোকানিকে মিলাররা পাম অয়েল দিচ্ছে। কিন্তু এসব পাম অয়েল আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কারণ এসব ডিও সরবরাহ দেয়ার সময় ৭-১৫ দিন পর্যন্ত সময় থাকে। এই সময়ের মধ্যেই বাজারে পুনরায় বেশি দরে এসব তেল বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এখানে সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এদিকে ভোজ্যতেলের অনিয়ন্ত্রিত বাজারের কারণে খাতুনগঞ্জের অনেক বড় ব্যবসায়ী ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, আমরা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু মিলাররা সরকারি দরে দিলেই সেগুলো বিক্রি করছি।
এদিকে ভোজ্যতেলের পাশাপাশি চিনির দামও বাড়ছে। অথচ রমজান শুরুর আগেই অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়েছে সরকার। আগে যেখানে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হতো এখন, আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হচ্ছে। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত এ সুবিধা ভোগ করবেন আমদানিকারকরা। অথচ বাজারে এর প্রভাব নেই। রমজানের শুরুর ১৫ দিনেই প্রতি মণ চিনিতে দাম বেড়েছে ২শ টাকা। গত ৩ এপ্রিল খাতুনগঞ্জে এস আলম চিনি প্রতি মণ ২ হাজার ৬২০ টাকা, সিটি ও ফ্রেশ (মেঘনা গ্রুপের) চিনিও প্রতি মণ ২ হাজার ৬৪০ টাকায় বিক্রি হলেও ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রতি মণ চিনি ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাতুনগঞ্জে সবচেয়ে বেশি চিনি আসে এস আলম সুগারের। কিন্তু গত সপ্তাহে এস আলম সুগার বাজারের চেয়ে কিছু কম মূল্যে চিনি বিক্রি করেছে। ওই সময় হাজার হাজার টন চিনির ডিও কিনে নিয়েছেন বড় দুই ব্যবসায়ী। এখন মধ্যস্বত্বভোগী ওইসব ব্যবসায়ী ডিও’র মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিও ব্যবসায়ী বলেন, খাতুনগঞ্জের একজন বড় তেল ও চিনি ব্যবসায়ী কয়েক হাজার টনের ডিও কিনে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে সৌদি আরবে চলে গেছেন। সৌদি আরবে বসেই তিনি এখন ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। রমজানের শুরুতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা ওই ব্যবসায়ীকে খুঁজতে খাতুনগঞ্জে অভিযান চালালেও ওইদিন তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সটকে পড়েন। সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ভোজ্যতেল বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি। সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কস্টিং বেশি হচ্ছে। বেশি দামে কিনে কেউ কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না। তাই বাজারে অস্থিরতা রয়ে যাচ্ছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার আসলে ব্যবসায়ীদের হাতে বাজার ছেড়ে দিয়েছে। তা না হলে এখন শুধু জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান ছাড়া মাঠে প্রশাসনের কোনো কর্তৃপক্ষকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাণিজ্যমন্ত্রী রমজানের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রমজানে সমন্বিত অভিযান চলবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো অভিযান হচ্ছে না। যার সুযোগ নিচ্ছেন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। যে কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তেল ও চিনির দাম বাড়ছে। ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারদর স্বাভাবিক রাখার জন্য রোজার শুরু থেকে খাতুনগঞ্জে কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। আমাদের অভিযানের সময় অনেক ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে চলে যান। এখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আবারও অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, সামনে ঈদ। তাই ভোক্তাদের ঈদের কেনাকাটা নির্বিঘœ করতে ঈদ মার্কেটে অভিযান চলছে।