যুদ্ধের দামামায় সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশের পোশাকখাত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫৪ পিএম, ৬ মার্চ,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৩৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
করোনা মহামারির মধ্যে পোশাক কারখানা খোলা রাখার সাহসী সিদ্ধান্তে এ খাতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখেছেন রফতানিকারকরা। গত বছর ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে তিন হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম আট মাসে (জুন- ফেব্রুয়ারি) দুই হাজার ৭৫০ কোটি (২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রফতানি করা হয়েছে, যা মোট রফতানির আয়ের ৮১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময়ে মোট তিন হাজার ৩৮৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। অর্থের এই অংকই বলে দিচ্ছে, করোনা সংক্রমণের মধ্যেও পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধিতে সুবিধাজনক অবস্থানেই ছিলেন রফতানিকারকরা। কিন্তু চলতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সম্প্রতি বেধে যাওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে রফতানিকারকদের কপালে। তারা এ দুই ইস্যুর কারণে বড় সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছেন।
প্রথম ধাক্কা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি : বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে গত নভেম্বরে দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ২৩ শতাংশ বা ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। এরপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারে দুই দফায় (যথাক্রমে ৬২ ও ১৫১ টাকা করে) মোট ২১৩ টাকা দাম বাড়ানো হয়। ফলে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তার আগে থেকে বিশ্ববাজারে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া বাড়তি ছিল। এর মধ্যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গিয়ে চাপে ফেলেছে রফতানিকারকদের। এ বিষয়ে নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পোশাকখাতের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় আমরা ভর্তুকির দাবি জানিয়েছিলাম। অন্তত এক বছর ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব সেক্টরে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। যে যেভাবে পারছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। তাই সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিল্প কারখানার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ফের দাম বাড়লে বাধাগ্রস্ত হবে রফতানি, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শিল্প মালিকরা। তাছাড়া সব কিছুর খরচ বেড়ে গেলে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবো না। প্রতিযোগিতা না করতে পারলে রফতানিতে পিছিয়ে যাবো।
‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : কনটেইনার সংকটের মধ্যে দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যখন পরিবহন খরচ আরও বাড়িয়ে পোশাকখাতকে চাপে ফেলেছে, তার মধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আঘাত করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আগে থেকে বাকযুদ্ধ ও হুমকি-পাল্টা হুমকির পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে তিন দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে মহাশক্তিধর রাশিয়া। পি মোদের বন্ধু ইউক্রেনে রাশিয়া এভাবে যুদ্ধ শুরু করায় তাদের কোণঠাসা করতে ‘নিষেধাজ্ঞা’ নামক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। এরই ধারাবাহিকতায় আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে বার্তা আদানপ্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো। সম্প্রতি সুইফট তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে জানায়, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সহযোগী দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে পরামর্শ করে একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। যুদ্ধের পরিস্থিতি শান্ত করতে রাশিয়াকে সুইফট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুইফট এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। সংস্থাটির এ সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, সুইফটের এ সিদ্ধান্তে রাশিয়ায় রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। ওই সিদ্ধান্তের পর এক বিবৃতি দেয় বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তাদের তরফ থেকে বলা হয়, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পোশাকশিল্পে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির জন্য একটি সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান বাজার রাশিয়ার ওপর বেশ কয়েকটি দেশ ব্যাপক পরিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর অ্যাকসেস বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের বাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিবৃতিতে বিজিএমইএ মহাসচিব ফয়জুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। রাশিয়ান ক্রেতাদের তথ্যাদি, বকেয়া পেমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিবরণ আমাদের কাছে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের সদস্য ও রফতানিকারকদের বলেছি, তারা যেন কালবিলম্ব না করে তাদের ক্রেতা ও লিয়েন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়।
এ বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুদ্ধ বা দুর্যোগ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের আমদানি-রফতানিতেও প্রভাব পড়বে। আগেই জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে, এর মধ্যে যদি আবার দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ে, দেখা যাবে সব সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তবে যুদ্ধে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল-গ্যাসের দামও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ফের জাহাজভাড়া বাড়লে দেশের আমদানি ও রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রফতানি সীমিত হওয়ার শঙ্কা : ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা দেশীয় মুদ্রায় পাঁচ হাজার ৭৪ কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে, একই সময়ে ইউক্রেনে রফতানি হয়েছে এক কোটি ১৭ লাখ ডলারের বা ১০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাশিয়ায় ৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, একই সময়ে ইউক্রেনে রফতানি হয়েছে ৭৯ লাখ ডলারের পোশাক। যুদ্ধের কারণে এ দুই দেশেই ব্যবসা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, যুদ্ধাঞ্চল ইউক্রেনে যেমন রফতানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তেমনি অর্থ লেনদেনের জটিলতায় এখন রাশিয়ায়ও রফতানি সীমিত হয়ে আসবে। তাছাড়া করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার বাজারে নতুন পণ্য রফতানির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেই সুযোগ অনি য়েতায় পড়বে। পোশাকসহ যেসব পণ্য রফতানি হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, সেগুলোর রফতানিও সীমিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, রাশিয়ায় রফতানির অর্থের বড় অংশই তৃতীয় দেশ সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে আসে। ফলে সেভাবে শঙ্কার কিছু নেই বলে তারা মনে করেন।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রাশিয়ায় আমাদের যেসব পোশাকপণ্য যায় তার সিংহভাগ বা ৮০ শতাংশ যায় থার্ড কান্ট্রি কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে (তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে)। থার্ড কান্ট্রি থেকে পেমেন্ট আসায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ২০ শতাংশ পোশাক সরাসরি রাশিয়ান কাস্টমারদের কাছে রফতানি করা হয়, যা এ মুহূর্তে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা তাদের পেমেন্ট পাঠানোর সিস্টেম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে রাশিয়ান কাস্টমাররা আমাদের পেমেন্ট দিতে পারছেন না। তাই পণ্য পাঠিয়ে পেমেন্ট অনি য়েতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমরা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করছি সরাসরি রাশিয়ানদের সঙ্গে আপাতত ব্যবসা না করতে।
যুদ্ধ থেমে যাওয়ার আশায় অর্থমন্ত্রী : রাশিয়াকে সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দেয়ায় তাদের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সুইফট রাশিয়ার সঙ্গে ডিসকন্টিনিউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি সুইফটের কারণে কোনো পেমেন্ট না করা যায়, তাহলে অন্যরকম ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই বিশ্বমানবতার স্বার্থে এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। বিশ্বের মানুষ যেন শান্তি পায়, এটা আমার প্রত্যাশা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, এটা নিয়ে এখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এটা নিয়ে গত বৃহস্পতিবারও একটা সভা হয়েছে।