চাকরি হারিয়ে, আয়-রোজগার কমে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগান্তি
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে মূল্যস্ফীতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪১ পিএম, ৪ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০৯ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে মূল্যস্ফীতি। নিত্যপণ্যের দাম যে হারে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইলে চলে যাচ্ছে, তাতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে না দিয়ে আটকে রাখাটা অনেক কঠিন বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, করোনায় চাকরিহারা, বেকার, আয়-রোজগার কমে যাওয়া মানুষের খরচের টাকা জোগাড় করা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বড় ধরনের ভোগান্তিতে ফেলেছে অনেক পরিবারকে। এতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ২০২১-২২ অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থবছরের শুরুতে এই হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার অর্থমন্ত্রীর ঘোষণাও ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এর নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার দাবি, ‘গত ১৫ বছরে মূল্যস্ফীতির হার দেশে গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার আরও বেশি ছিল। কাজেই আমি বলবো, বাংলাদেশ একটি অসাধারণ দেশ।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এটি সমন্বয় করতে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়। এর ফলে পণ্য ও সেবা খাতের ব্যয় বেড়ে গেছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়েছে। গত এক বছরে নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারি হিসাবে দাম বেড়েছে চাল ৭৯ শতাংশ, খোলা আটা ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, খোলা ময়দা ৩৭ দশমিক ৬৮, সয়াবিন ২৮ দশমিক ১১, পামঅয়েল ৩৮ ও মসুর ডাল ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ বছর মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। যেকোনো মূল্যে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। না হলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। যে কারণে দেশে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্য ও সেবা খাতে। এ জন্য মূল্যস্ফীতির দিকে নজর দিতে হবে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে সংসারের নিত্যপণ্যের বাজারে। ১৫ হাজার টাকা মাসে আয় করা মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে সবার জন্য ডাল-ভাত জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালে অক্টোবরে রাশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, পোল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার ছাড়িয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। কোনো কোনো দেশ ছাড়িয়েছে দুই অঙ্ক। ট্রেডিং ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোর মূল্যস্ফীতি হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, রাশিয়ার ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে, আর্জেন্টিনার ৫২ দশমিক ২ শতাংশ, ব্রাজিলের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, তুরস্কের ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ, শক্তিশালী চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনীতিবিদদের সামনের বছরের অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে। কারণ করোনা মহামারির কারণে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন করোনার সংক্রমণ কিছুটা কম হওয়ায় এবং দেশে দেশে টিকা নেয়ার হার বাড়ায় জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরেছে। কিন্তু নতুন এই চাহিদা সঙ্গে সরবরাহ তাল মেলাতে না পারায় জীবনযাত্রার খরচ বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ২০২১ সালের নভেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আগের বছর একই মাসে ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭০। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ হয়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে তা ২০২০ সালের নভেম্বরের তুলনায় কম। ওই বছর নভেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। নভেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে। এ খাতে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আগের বছর একই সময়ে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়েছে। এটি স্থিতিশীল ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের যে তথ্য তার সঙ্গে বাস্তবতার তফাৎ আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে ধনী আরও ধনী হবে। এছাড়া সরকারের কিছু নীতি পরিবর্তন করতে হবে বলেও জানান তিনি। করোনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সবকিছুর চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।