পদ্মা ব্যাংকের ‘লোকসান গোপনের আয়োজনে’ উদ্বেগ টিআইবির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৭ পিএম, ১০ জানুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৪৪ এএম, ১৩ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিদেশি বিনিয়োগ পেতে পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী থেকে লোকসানের তথ্য গোপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি দেওয়ার যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ দেখিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এমন সুবিধাকে ‘অনৈতিক ও প্রতারণামূলক’ আখ্যা দিয়ে গত শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি বলছে, ‘এটি সামনের দিনে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যাকে প্রকটতর করার পাশাপাশি বিদেশে সুনাম ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি তৈরি করবে।’ অন্যদিকে পদ্মা ব্যাংকের দাবি, সব আইন ও আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং মানদ- মেনেই পদ্মা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে পদ্মা ব্যাংক মিথ্যা, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলছে। টিআইবির বিবৃতিকেও উদ্ভট বলছে প্রতিষ্ঠানটি।
লোকসানে ডুবে থাকা পদ্মা ব্যাংকের নাম ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে ছিল ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি চালুর পর থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, সাবেক আমলা মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিন বছরের মধ্যে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটিতে ২০১৬ সালে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চাপের মুখে পরের বছর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
নতুন চেয়ারম্যান হন রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট ও কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক হয়।
ওই সময় পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
তাতেও রেহাই হয়নি, টিকে থাকার জন্য ব্যাংকটি সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার অথবা সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় পদ্মা ব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বিষয়টি নিয়ে পরে বলেছিলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হলে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
টিআইবি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “সমস্যাকবলিত পদ্মা ব্যাংকের জন্য ৭০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেলমর্গানের শর্তানুযায়ী ব্যাংকটির আর্থিক লোকসানের তথ্য হিসেব বিবরণী থেকে গোপন রেখে পৃথক হিসাব তৈরির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়েছে, পরবর্তী দশ বছরে যা ব্যাংকটির মুনাফা থেকে সমন্বয় করার কথা। দেশের ব্যাংকিং খাতে এমন অনৈতিক উদ্যোগ নজিরবিহীন।”
বিনিয়োগ আনতে ব্যাংকটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ‘স্বচ্ছ’ দেখাতেই পদ্মা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তথ্য গোপনের প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদন করা হয় বলে একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন, পরিচালকদের ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণে ডুবতে থাকা বেসরকারি ব্যাংকটিকে বাঁচাতে ৭০০ কোটি টাকার বেশি মূলধন যোগানোসহ বেশ কিছু নীতি সহায়তাও দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু তারপরও ব্যাংকটির ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বরং লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে দিনকে দিন।
“এমন অবস্থায় লোকসানের তথ্য বাদ দিয়ে ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী পরিষ্কার দেখানোর চেষ্টা হিসাববিজ্ঞানের দিক থেকে শুধু অনৈতিকই নয় বরং প্রতারণামূলকও বটে, এটি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের নামে লুণ্ঠনতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতার নামান্তর।”
ফারমার্স ব্যাংককে অবসায়ন না করে পদ্মা ব্যাংক নামে বাঁচিয়ে রাখার ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ কার বা কাদের স্বার্থে সরকার বয়ে চলছে সেই প্রশ্ন তুলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, “আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকও কেন ব্যাংকটি বাঁচাবার নামে নজিরবিহীন সব উদাহরণ তৈরির দায় নিচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক বিবরণী কৃত্রিমভাবে ভালো দেখালেই প্রতিশ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ যোগাড় করা সম্ভব হবে তার গ্যারান্টি কি?”
আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক তার সিদ্ধান্ত পুর্নমূল্যায়ন করবে বলে আশাপ্রকাশ করেছে টিআইবি।
অন্যদিকে টিআইবির বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে পদ্মাব্যাংক। গত রবিবার পদ্মা ব্যাংক থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এহসান খসরুর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পদ্মা ব্যাংককে কোনো ছাড় দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। বরং পদ্মা ব্যাংকের ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী সুসংহত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেছে। সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে।
টিআইবির বিবৃতিতে পদ্মা ব্যাংকের সম্পদ বিবরণী থেকে লোকসানের তথ্য গোপনের বিষয়টিকে ‘প্রতারণামূলক সুবিধা’ বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে এহসান খসরু বলেন, একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এমন একটি স্বচ্ছ উদ্যোগকে ‘প্রতারণামূলক সুবিধা’ বলে আখ্যায়িত করে বিবৃতি দেওয়ায় আমি হতবাক হয়েছি। কোনো ধরনের গবেষণা না করে, ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ, যাচাই-বাচাই না করে শুধু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠন এমন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক বিবৃতি দেওয়া বিস্ময়কর ঘটনা। এটাকে আমি স্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠানের অস্বচ্ছ বিবৃতি বলছি। এ ধরনের উদ্ভট বিবৃতি টিআইবি কোনোভাবেই দিতে পারে না।
পদ্মা ব্যাংকের এমডি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে যে সহায়তা করছে, সেটি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে একই ধরনের সহায়তা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
পদ্মা ব্যাংক বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানি পদ্মা ব্যাংকে ৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর অর্ধেক বিনিয়োগ হবে মূলধন হিসেবে। বাকি অর্ধেক হবে বন্ড বা অন্য উপায়ে। এই বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিসহ সব ধরনের নিয়ম-কানুন মেনে পদ্মা ব্যাংক কাজ করছে।
এহসান খসরু বলেন, পদ্মা ব্যাংকের ২০২০ সালের আর্থিক বিবরণী ভালোভাবে দেখে বিশ্লেষণ করে গবেষণা করে ডেলমর্গান পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে রাজি হয়েছে। ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এখান থেকে তারা ভালো মুনাফা পাবে— এসব বিচার-বিশ্লেষণ করেই ডেলমর্গান এই ব্যাংকে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এখানে কোনো ধরনের অস্বচ্ছ তথ্য দেওয়া হয়নি। কোনো ধরনের প্রতারণারও আশ্রয় নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন এসেছে এবং যার ওপর ভিত্তি করে টিআইবি বিবৃতি দিয়েছে, তার সবই মিথ্যা, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
তিনি বলেন, সদ্য শেষ হওয়া ২০২১ সালের আর্থিক বিবরণী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে পদ্মা ব্যাংক, যা স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সঙ্গে তৈরি করা হচ্ছে। সাবেক ফারমার্স ব্যাংক থেকে নতুনভাবে পদ্মা ব্যাংক তার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে কোনো ধরনের প্রতারণা হয়নি। সবকিছু স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সঙ্গে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান মেনেই হয়েছে।
পদ্মা ব্যাংক আরও বলছে, ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে। সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দেয়। ফলে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশই সরকারি ব্যাংকের হাতে।
এহসান খসরু বলেন, গত চার বছরে আমরা ব্যাংকটির অনেক উন্নতি করেছি। গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছি, আমানত বেড়েছে। ঋণ বিতরণও করছি আমরা এখন। বাংলাদেশ ব্যাংকও আমাদের কাজে খুশি। ডেলমর্গানও অ্যানালাইসিস করে দেখতে পেরেছে, এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করলে তারা ভালো রিটার্ন পাবে। সে কারণেই বিনিয়োগের ব্যবস্থা করছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই বিনিয়োগে সব ধরনের সহায়তা করছে। এখানে সবকিছু স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সঙ্গেই হচ্ছে।
টিআইবির বিবৃতি প্রসঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী এহসান খসরু আরও বলেন, যারা (টিআইবি) স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করে, তারা অস্বচ্ছ ধারণা বা চিন্তা নিয়ে কী করে এ ধরনের বিবৃতি দেয়, আমি বুঝতে পারি না।