ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, চাপ বাড়ছে হাসপাতালে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১১ এপ্রিল,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫১ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
মহামারি না হলেও প্রতিদিনই বাড়ছে ডায়রিয়ার রোগী। এতদিন শুধু রাজধানীতে রোগীর চাপ বেশি হলেও দিন দিন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। শুরু থেকেই রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে ডায়রিয়ার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে সম্প্রতি রোগীর চাপ বাড়ায় রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালেও সহজলভ্য করা হয়েছে চিকিৎসাসেবা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো বড় হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর চাপ। ঊর্র্ধ্বমুখী ডায়রিয়ার এ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পানিকে নিরাপদ করার কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এদিকে, এতদিন ওয়াসার পানিকে ৯২ শতাংশ নিরাপদ হিসেবে দাবি করলেও এবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেছেন, তার নিজের বাড়ির পানিতেও দুর্গন্ধ রয়েছে। পানির এই দূষণ রোধে এখনি ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরু থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৪১৯ জন রোগী। মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ এপ্রিল হাসপাতালটিতে ভর্তি হন ১ হাজার ২৭৪ জন রোগী। ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ২ এপ্রিলও। এদিনও ১ হাজার ২৭৪ জন ভর্তি হন। এরপর ৩ এপ্রিল ১ হাজার ১৭১ জন, ৪ এপ্রিল ১ হাজার ৩৮৩ জন, ৫ এপ্রিল ১ হাজার ৩৭৯ জন, ৬ এপ্রিল ১ হাজার ৩৭০ জন, ৭ এপ্রিল ১ হাজার ৩৮২ জন, ৮ এপ্রিল ১ হাজার ৩৭৫ জন, ৯ এপ্রিল অর্থাৎ শনিবার দুপুর তিনটা পর্যন্ত ৮১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। এই হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ দিনে ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে এসেছে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার রোগী। একই অবস্থা অন্য হাসপাতালগুলোরও। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীই বলছেন দূষিত এবং দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান এবং খাবারে ব্যবহার করার কারণেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
আইসিডিডিআরবিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী রমেশ সাহা জানান, রাজধানীর পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকার বাসিন্দা তিনি। কয়দিন থেকে বাসার পানির রং হালকা খয়েরি ছিল। এই পানিই ফুটিয়ে পান করেছেন সবাই। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরিবারের সবাই মিলে আক্রান্ত হয়েছেন ডায়রিয়ায়। অন্যরা বাড়িতে ওরস্যালাইন খেয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও নিজের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ায় এসেছেন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে। ওয়াসার লাইনের পানির রং হালকা খয়েরি বলে অভিযোগ করেছেন রাজধানীর মগবাজারের নয়াটোলা এলাকার বাসিন্দা মাহফুজ আহম্মেদও।
তিনি বলেন, প্রথমে মনে করেছিলাম পানির ট্যাঙ্কিতে ময়লা জমেছে। সেদিন মিস্ত্রি এনে পুরো ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করিয়েছি। কিন্তু তারপরও এরকম রংয়ের পানিই আসছে। দুর্গন্ধও প্রচুর। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে এই পানি ব্যবহার করছি আর পুরো পরিবার মিলে আতঙ্কে দিন পার করছি। এতদিন ওয়াসার পানিকে ৯২ ভাগ বিশুদ্ধ দাবি করে আসা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান নিজেও এবার স্বীকার করেছেন তার বাসার পানিতেও দুর্গন্ধ।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমার বাসায় সরবরাহ করা পানিও কিছুটা গন্ধযুক্ত। তবে এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। শীতলক্ষ্যার চরম দূষিত পানি পরিশোধনের পরও তাতে এ্যামোনিয়ার গন্ধ থেকে যায়। তাই কিছু এলাকার পানিতে এ গন্ধ থাকে। এখানে প্রিট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। তবু পানিতে গন্ধ থাকে। এ পানি ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়, যাতে গন্ধ কম লাগে। তবু গন্ধ থেকে যায়। সম্প্রতি রাজধানীর যেসব এলাকা থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত অধিক রোগীর তালিকা আইসিডিডিআরবি আমাদের দিয়েছে সেই ১০ এলাকার পানি আমরা আরও আগেই পরীক্ষা করিয়েছি। আমাদের নিজেদের ল্যাবে পরীক্ষা করা ওই পানিতে কোনো ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়নি। যাতে করে ডায়রিয়া হতে পারে। তারপরও সাবধানতা হিসেবে সেসব জায়গার পানিতে আমরা ক্লোরিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে করে কোনো জীবাণুরই বেঁচে থাকার কথা না। কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী ডায়রিয়া প্রতিরোধে পানি শতভাগ বিশুদ্ধকরণের বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, মহামারি আকার ধারণ করার আগেই ওয়াসাকে পানি শতভাগ বিশুদ্ধকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোন এলাকার খাওয়ার পানির লাইনের সঙ্গে সুয়ারেজের লাইনের সংযোগ হয়েছে। একে একে সবগুলো এলাকায় পরীক্ষার মাধ্যমেই এটি বের করা সম্ভব। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই পানি বিশুদ্ধ করতে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন সেটিও করতে হবে। এখানে ওয়াসার ফাঁকা বুলি ছোড়ার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে ঊর্ধ্বমুখী এ রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইসিডিডিআরবির চিকিৎসকদের। হাসপাতালটির বারান্দার আনাচে-কানাচেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। হাসপাতালের প্রধান ডাঃ বাহারুল আলম বলেন, আমাদের মোট শয্যা সংখ্যা ছিল ৪৬৮টি। রোগীর চাপ বাড়ায় তাঁবু খাটিয়ে প্রথমে শয্যা বাড়ানো হয় ৮৯টি। পরবর্তীতে আরও ৫০টি শয্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। তাই হাসপাতালের বারান্দাগুলো পর্যন্ত রোগীদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে ওঠে। এতে করে স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘœ হচ্ছিল। তাই আরও ৪০টি শয্যা বাড়ানো হয়। এই পরিমাণ রোগী বাড়তে থাকলে চিকিৎসা দেয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।