প্রায় প্রতি মিনিটে ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হচ্ছেন আইসিডিডিআরবিতে
বেড়েছে ডায়রিয়া রোগী, দুই জেলায় আক্রান্ত ৬৫১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০৩ পিএম, ২৯ মার্চ,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৫২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েই চলছে। আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে প্রায় প্রতি মিনিটে মিনিটে ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩৮ জন ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন।
আর গত ১৪ ঘণ্টায় (অর্থাৎ রাত ১২টার পর থেকে) আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৭৬৯ জন ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগী। এই সংখ্যা আগের দিন উল্লিখিত সময়ে ছিল ৭২৪ জন। ডায়রিয়ার রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
আইসিডিডিআরবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। হাসপাতালের বাইরে তাঁবুতেও রোগীদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। এখন হাসপাতালের বাইরে বড় দুইটি অস্থায়ী তাঁবু স্থাপন করে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোগীদের বেশিরভাগ বয়স্ক ও শিশু। তবে চিকিৎসাসেবা দেয়ার বিষয়ে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। হাসপাতালের শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় তাঁবু টানিয়ে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি। এখন সেখানে প্রায় ১৫০০ রোগীর ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন।
আইসিডিডিআরবির এক চিকিৎসক জানান, ঘণ্টায় ৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। আইসিডিডিআরবি সূত্র বলছে, সারাবছর দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ ডায়রিয়া রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে রোগীর সংখ্যা কিছু বাড়ে। সাধারণত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ সপ্তাহে রোগী চূড়ান্তভাবে বাড়ে। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। আইসিডিডিআরবির এসিস্টেন্ট সায়েন্টিস্ট ডা. শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, খাবার ও পানির মাধ্যমে ডায়ারিয়ার জীবাণু সংক্রমিত হয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মোহাম্মদপুর, শনির আখড়া, উত্তরা থেকে বেশি রোগী আসছেন। এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের তুলনায় প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেশি আসছেন। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ পানি ও খাবারের বিকল্প নাই। সবচেয়ে ভালো ঘরে তৈরি করা খাবার ও ফুটানো পানি খেতে হবে। পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। আইসিডিডিআর,বির বরাত দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র বলছে, চলতি মাসের ২৯ মার্চ পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে মোট ২৭ হাজার ৩৭ জন ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে হঠাৎ করেই পটুয়াখালী ও চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে এই দুই জেলায় ৬৫১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে হাসপাতালে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়িতে। পটুয়াখালী ও চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদে জানা যায়-
পটুয়াখালী : আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে জেলায় ৪৫১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে ডায়রিয়া রোগী বাড়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। ফলে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে করিডোরে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। সদর উপজেলার কৃষক আব্বাস উদ্দিন বলেন, শুক্রবার খেতে কাজ শেষে পাশের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তরমুজ খাই। পরের দিন থেকে ডায়রিয়া শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হই। গলাচিপা এলাকার বাসিন্দা শ্রী সুমন পাল বলেন, আমার বৌদি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। এখানে ভর্তি করার পর মাত্র একটি স্যালাইন দিয়েছে। এখানে কোনো ওষুধ নেই। পরে আমরা বাইরে থেকে স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে আনি। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শুভ্রত সাহা বলেন, তীব্র গরম ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার না করায় ডায়রিয়ার প্রধান কারণ। গরমে বিশুদ্ধ পানি পান, খাবার আগে হাত ধোয়ার পাশাপাশি খাবার স্যালাইন খাওয়া ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন তিনি। পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হাসান বলেন, রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রচন্ড গরমে সাধারণত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ে। ডায়রিয়া মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ওষুধ এবং স্যালাইন মজুত আছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
তিনি আরও বলেন, গত তিন মাসে জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২৫৪৫ জন আর গত ৭ দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬০ জন। এক হাজার সিসির আইভি স্যালাইন ১৪ হাজার ১০০ পিস ও পাঁচশ সিসির ৬ হাজার ৩৮০ পিস মজুত আছে।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গত এক সপ্তাহে শিশুসহ ২০০ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। সোমবার (২৮ মার্চ) রাত ১২টা পর্যন্ত ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৭৫ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুসহ ২০০ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে ১০০-১৫০ জন ডায়রিয়া রোগী। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই শিশু ও বয়স্ক। সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৫ জন। ওই দিন শিশুসহ ভর্তি হয়েছে ৩০ জন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, দুটি কক্ষ নিয়ে ডায়রিয়া ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে কোনো শয্যা খালি নেই। ফলে মেঝেতেই শিশুসহ রোগীদের থাকতে হচ্ছে। জায়গা না থাকায় বাইরের বারান্দা ও সিঁড়িতেও রোগীদের চিকিৎসা চলছে। সব মিলে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সরা। শারমিনা হক নামে এক নারী বলেন, হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কোনো জায়গা নেই। গতকাল তিন দিন ধরে সিঁড়িতে আমার দুই বছরের বাচ্চার চিকিৎসা চলছে। এখনো তার অবস্থা ভালো নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, আরও কয়েক দিন থাকতে হবে। উজ্জ্বল মাসুদ নামে এক যুবক বলেন, তিন দিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত আমি। সোমবার দুপুরে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। ওয়ার্ডে কোনো জায়গা নেই। বারান্দায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
সুমন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, গতকাল বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুচকা খেয়েছিলাম। সন্ধ্যা থেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্সরা জানান, এই কয়েক দিনে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই শিশু ও বয়স্ক। চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিনকার কাজকর্মে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং সব সময় সুপেয় পানি পান করলে ডায়রিয়া থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ফাতেহ আকরাম বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন ডায়রিয়ার রোগীকে ভর্তি করা হচ্ছে। এছাড়াও বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১০০-১৫০ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে একটু সচেতন হলে এসব রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ।