ক্লাস ফাঁকি দেওয়া শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:২৩ এএম, ২৮ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০১:২৪ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে আতঙ্কে রয়েছে সারা দেশের মানুষ। প্রতিদিনই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ তাদের ধরতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। মারামারি ছাড়াও মাদক গ্রহণ, বেচাকেনা, পর্নো আসক্তি, অনলাইনভিত্তিক জুয়া, কিশোর গ্যাংয়ে তারা যুক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়েও অংশ নিচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সম্প্রতি এক জরিপ চালায়। প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের অপরাধে জাড়িয়ে পড়ার পেছনে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
দিনটি ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম নগরের গণি বেকারি এলাকায় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল ড্রেস পরা কয়েকজন ছাত্র আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় জামালখানের দিক থেকে আরেকটি কিশোর গ্রুপ এসে সেখানে অবস্থান নেয়। এরপর শুরু হয় কথা কাটাকাটি। তারপর লাঠি, বেল্টসহ নানা উপকরণ দিয়ে শুরু করে মারামারি। সর্বশেষ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শেষ হয় ঘটনা। চট্টগ্রামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ, মারামারির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২২ সালে জামাল খান চেরাগী পাহাড় এলাকায় দুদলের বাগবিতণ্ডার জেরে হাতাহাতি শুরু হলে ছুরিকাঘাতে খুন হয় কলেজছাত্র ইভান।
সিএমপির জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বের হলেও তারা আদতে সেখানে যাচ্ছে না। অভিভাবকরাও বিষয়টি জানতে পারছে না। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বাধ্যবাধকতা না থাকার সুযোগে তারা পার্ক, রেস্টুরেন্ট ও খেলার মাঠে সময় কাটাচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ক্লাসে উপস্থিত না থেকে শিক্ষার্থীরা কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে কেউ যখন অন্য সহপাঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য শিক্ষার্থীও ‘গ্যাং সদস্য’ হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় কালবেলাকে বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত উপস্থিত থাকলে বিপদগামী কাজ থেকে অনেকটাই দূরে থাকবে। সম্প্রতি আমরা তিনটি স্কুলের ওপর জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে শ্রেণিকক্ষ থেকে পালিয়ে অনেক শিক্ষার্থী অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি অভিভাবক, শিক্ষকদেরও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনেকাংশেই কমে আসবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি নিশ্চিতের ব্যাপারে শিক্ষা বোর্ড থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা যেতে পারে।
জরিপে দেখা যায়Ñ সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩৮৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৮১ জন শিক্ষার্থী ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত ছিল। যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ শতাংশ। ১৫৫ জন শিক্ষার্থী ৫০ শতাংশ ক্লাসও করেনি।
গুল এ-জার বেগম সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দশম শ্রেণিতে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১১৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৩৩ জন শিক্ষার্থী ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন। ৬২ জন শিক্ষার্থী ৫০ শতাংশেরও কম ক্লাসে উপস্থিত ছিল। অন্যদিকে কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে একই শিক্ষাবর্ষের দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ২৭৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৯ জন শিক্ষার্থী ৮০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত ছিল। ৭০ শতাংশের বেশি ক্লাসে উপস্থিত ছিল ২৬ জন শিক্ষার্থী। ৯৭ জন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিতর হার ৫০ শতাংশেরও তম।
উপস্থিতি বাড়াতে কিছু সুপারিশ: স্কুলে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা অভিভাবককে জানাতে এসএমএস পদ্ধতি চালুর করার সুপারিশ করেছে সিএমপি। পাশাপাশি সুপারিশ করা হয়েছে, নবম, দশম ও একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির মোট ক্লাসের ন্যূনতম ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখা; যেসব শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার যৌক্তিক কারণে ৭০ শতাংশের কম থাকবে তাদের জন্য শিক্ষা বোর্ডের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা; ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা।
পাশের দেশের চিত্র: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরতে সিএমপির প্রতিবেদনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ভারতে কোন শিক্ষার্থী যদি ৭৫ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকে তাহলে সে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। তবে কারও উপস্থিতি যদি ৭৫ শতাংশের কম হয় তবে আঞ্চলিক বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিছু কিছু প্রদেশে স্কুলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থী উপস্থিত না হলে সেই তথ্য তাৎক্ষণিক অভিভাবককে জানিয়ে দেয়। ফলে ক্লাস চলাকালে অন্য কোনো স্থানে সময় কাটানোর সুযোগ পায় না শিক্ষার্থীরা।