নিত্যপণ্যের দাম চোখ রাঙাচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪৪ এএম, ২৮ জানুয়ারী,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:১৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের নতুন দাম। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এ জন্য সরকারের বিদ্যুৎ দপ্তর পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আরও এক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ঠিক করে রেখেছে। এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। অন্যদিকে, রমজান ঘনিয়ে আসায় এরই মধ্যে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের দাম। প্রতিকারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার কোনো কার্যকর প্রভাব পড়ছে না বাজারে। একদিকে ব্যাংকে ডলার সংকটে ঋণপত্র বা এলসি করতে পারছে না।
অন্যদিকে, এসব অজুহাত কাজে লাগিয়ে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। উৎপাদক, সরবরাহকারী ও পরিশোধনকারী কোম্পানির সঙ্গে সরকার আলাপ-আলোচনা করে যে দাম ঠিক করে দিচ্ছে, খুচরা পর্যায়ে গত ছয় মাসে তা বাস্তবায়ন করছে না সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তশালীরাও জীবনযাত্রা ব্যয়ের লাগাম টানছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রমজান মাসের চিন্তা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমদানি প্রক্রিয়া ঠিক না থাকলে রমজানে পণ্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত সীমায় রাখা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা।
আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে দুই থেকে ১০০ গুণের বেশি। চাল, ডাল, আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা মরিচ, হলুদ, জিরা, তেজপাতা, মাছ-মাংস, গুঁড়া দুধ, চিনি, লবণ, খেজুর, ডিম, আলু, শাকসবজি এবং লেখার কাগজের দাম থেমে থেমেই বাড়ছে। কমার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দেশে দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি বা ঋণপত্র খোলার হার কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। যদিও পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাদ্যপণ্যের আমদানি সহজ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চলছে দফায় দফায় বৈঠক। বিশেষ করে এলসি খোলার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলার সরবরাহে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শিল্প খাতে গ্যাসের নতুন দাম কার্যকর হবে। পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এ জন্য আগে থেকে সরকারের বিদ্যুৎ দপ্তর পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আরও এক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে রেখেছে। আর এসবের প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাজার চোখ রাঙাচ্ছে ভোক্তার দিকে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নবিত্ত থেকে বিত্তশালীরাও প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন পছন্দের খাবার। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা পড়েছেন মহাসংকটে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। পরিবারকে সন্তুষ্ট রাখতে দিনকে দিন ঋণের জালে জড়াচ্ছেন নিজেদের। রাস্তাঘাট, অফিস, আদালত, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের টং দোকানের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চলছে নিত্যপণ্যের বাজারদর নিয়ে আলোচনা।
বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গণমাধ্যম বলেন, গেল ছয় মাস পণ্যের যে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নির্ধারিত দাম থেকে ১০-১২ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। সামনে রমজান। সেজন্য আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা। সরবরাহ ঠিক থাকলে কেউ বাড়তি সুবিধা নিতে পারবে না। আর কোথাও কোনো সমস্যা হলে ব্যবসায়ীদের একটি চক্র বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের দপ্তর সব সময় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আগামীতেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করে দাম নির্ধারণ করা কতটুকু ঠিক হয়েছে, তা যেমন প্রশ্ন। তেমনি আমি মনে করি, ভোক্তাদের নির্ধারিত দামের সুবিধা পাওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের ব্যবসায়ীদের লোভস্ফীতি অনেক। তারা সুযোগ পেলে সুবিধা নিতে বসে থাকে। কোনো একটা সমস্যা হলেই তারা নিজ থেকে দাম বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য বলব, সরকার কঠোর হলে এসব সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ভোক্তার পকেট কাটতে পারবে না। সামনে রমজান, ভোক্তারা স্বস্তিতে নিত্যপণ্য কিনতে পারবেন। ভালোভাবে ইবাদত বন্দেগি করতে পারবেন। সে সময় যাতে রোজাদার সহজে নিত্যপণ্য পেতে পারেন, সরকারকে সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ ছাড়া কারসাজি চক্রকে চিহ্নিত করে কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
ভরা মৌসুমে বাড়ছে চালের দাম : বাজারে প্রতি কেজি চিকন চালের দাম ৭৫ টাকা, যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৭ টাকা বা সাড়ে ৫ শতাংশ বেশি। মাঝারি বা পাইজাম চালের দাম ৫৮ টাকা। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৩ টাকা বা ২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। আর মোটা চাল ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার দাম গত বছরের তুলনায় ২-৩ শতাংশ বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, এবার রোপা আমন চাষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ টন। বিপরীতে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৭০ লাখ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ লাখ টন বেশি। এরপরও চালের দাম বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আজিজ কালবেলাকে বলেন, অনুকূল আবহাওয়ায় এবার আমন চাষ এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি হয়েছে। আগের বছর থেকে দামও বেশি পেয়েছেন কৃষক। তবে যতটুকু বেশি মনে করা হচ্ছে, ডিজেল এবং শ্রমিক খরচ বাদ দিলে সে হিসাবে লাভ করতে পারেননি কৃষক। একইভাবে মিল মালিকরা পরিবহন ও উৎপাদন পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ায় ভরা মৌসুমে লাভের মুখ দেখছেন না। এজন্য বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য, কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত চাল আছে। বাজারে সরবরাহও ভালো। এই পরিস্থিতিতে যে দাম, তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবের সুযোগ নিয়ে চালকল মালিক ও বড় বড় বহুজাতি কোম্পানি সিন্ডিকেট করে চালের দাম কমতে দিচ্ছে না।
রমজানে পণ্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত সীমায় রাখতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পৃথক সভা করেছে। এসব সভার পর্যালোচনায় উঠে আসে, ডলার ও আন্তর্জাতিক বাজার হিসাবে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর থেকে অনেক বেশি বাড়তি। সেজন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে না পারলে রমজানে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কাঙ্ক্ষিত সীমায় রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের নিয়ে টাস্কফোর্স বা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসব সভা থেকে নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি বিশেষ করে আসন্ন রমজানের প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেছে এবং সব পক্ষ তাদের করণীয় এবং সুপারিশ তুলে ধরে। নিত্যপণ্যের মজুত ও বাজার পরিস্থিতি এবং আমদানিকারকরা তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বলেছেন।
আদা, রসুন, চিনি, ছোলা, ডালের দাম বাড়তি : রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে গেল বছরের এই সময়ের তুলনায় বাজারে ডালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ, আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৬৬ শতাংশ, ভোজ্যতেলে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ, পেঁয়াজে ১৮ শতাংশ, রসুনে সাড়ে ৪৫ শতাংশ, আদায় ১১১ শতাংশ, শুকনা মরিচের ৭৫ শতাংশ, হলুদে ১২ শতাংশ, জিরার ৮৯ শতাংশ, তেজপাতার ১৯ শতাংশ, মাছ-মাংসের ৫ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত, গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ২৮ থেকে ৪০ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, লবণে ২৩ শতাংশ, খেজুরে ২০ শতাংশ, ফার্মের ডিমে ১৬ শতাংশ এবং আলুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত।
ঋণপত্র খোলার হার কমছে উল্লেখযোগ্য হারে : রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, ডালসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। স্থানীয় পেঁয়াজ পর্যাপ্ত থাকায় রমজানে সংকটের আশঙ্কা নেই। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ক্রুড সয়াবিনের এলসি খোলার পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। একইভাবে পরিশোধিত পাম অয়েলের এলসি ২০২১ সালের একই সময়ের কাছাকাছি হলেও গেল ডিসেম্বরে পরিশোধিত সয়াবিন ও ক্রুড পাম অয়েলের কোনো এলসিই খোলা হয়নি। অথচ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ দুই পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় ৩৭ হাজার টন। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় গেল বছরের এই ছয় মাসে চিনি আমদানি ২ লাখ টন কম হয়েছে। গত ডিসেম্বরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৫২ টন, ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১১৯ টন। ফলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না ব্যবসায়ীরা। ২০২১ সালের জুন-ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের এই সময়ে ছোলা আমদানি কমেছে ১৪ হাজার ১৬৪ টন। এ বছর ডিসেম্বরে ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৯ হাজার ৮১৮ টন, আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৯৩৩ টন।