৭ হাজার গ্রাহকের টাকায় আজাদ গড়েছেন ফ্ল্যাট-জমি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৪৭ পিএম, ১৯ অক্টোবর,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:১০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বিভিন্ন জেলায় জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে সাত হাজারের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হন খন্দকার আবুল কালাম আজাদ। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার দায়ে তার বিরুদ্ধে হওয়া ৬০ মামলার ৩৬টিতেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। অবশেষে সেই আজাদকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গতকাল মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে ‘জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান খন্দকার আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩ এর একটি দল। র্যাব বলছে, ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খন্দকার আবুল কালাম আজাদ নামের গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ‘জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তিনি উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করেন। ২০১৩ সাল থেকে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বৃহদাকারে ‘জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। সম্প্রতি জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এসব জেলার হাজার হাজার সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ভুক্তভোগীরা। র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির মাধ্যমে গতরাতে র্যাব-৩ এর অভিযানে রাজধানীর কল্যাণপুরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের মূল অভিযুক্ত খন্দকার আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করে।
তিনি বলেন, সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা অঙ্কের ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রাহকরা ‘তফসিলি ব্যাংক’ মনে করে তাতে আমানত রাখতে শুরু করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়ায় ব্যবসায়ীরা ঝুঁকে পড়েন। বিভিন্ন জেলা শহর গুলোতে দৃষ্টিনন্দন ও নামীদামী বাড়ি ভাড়া নিয়ে চাকচিক্যময় অফিস খুলেন। মূলত পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবসা শুরু করে যেখানে তার স্ত্রী, ছোট ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী মিলে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। এভাবে অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করতে সক্ষম হয়। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীসহ প্রতিটি জেলা থেকে অফিস গুটিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আজাদ। তিনিসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নিয়ে উক্ত জেলাগুলোতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, ২০০৫ সালে মেহেরপুর জেলা শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস মোড়ে একটি ভাড়া বাসায় জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে কুষ্টিয়া, খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখা চালু করে। যার সভাপতি ছিলেন আবুল হাশেম ও সম্পাদক নাহারুল ইসলাম। ২০১৭ সালে সমিতির গ্রাহক সংখ্যা ৭-৮ হাজার হয় এবং গ্রাহকরা ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত রাখে। ব্যবসা শুরুর পর থেকে জামানত গ্রহণের পাশাপাশি মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য জামানত প্রদানকারী গ্রাহকদের মুনাফা দেওয়ার কার্যক্রমও চালায়। তবে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার আগে আজাদ প্রদানকৃত অর্থও গুছিয়ে নিতে থাকে।
২০১৭ সালে তার দেওয়া হিসাব মতে, তার নিকট রক্ষিত গ্রাহকদের সঞ্চয়-আমানতের পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ৫০-৭০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে গ্রাহকদের বিভিন্ন আশা দেখিয়ে তাদের নিকট হতে রক্ষিত সকল জামানতের অর্থ নিয়ে ২০১৭ সালে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আঞ্চলিক সকল অফিস গুটিয়ে নেন। যোগাযোগের সকল ফোন নম্বর একযোগে বন্ধ করে ঢাকার উত্তরায় এসে গা ঢাকা দেন। পালানোর সময় মাঠপর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ৩২ লাখ ছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় আজাদ। যা তিনি আর সংগ্রহ করতে পারেননি।
কমান্ডার মঈন বলেন, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেপ্তার আজাদের সাথে ৮ শতাধিক কর্মী ছিলেন। যাদেরকে কোনো বেতন দেয়া হতো না। তাদের গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে বার্ষিক ১৮-২০ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। গ্রাহকদের থেকে উচ্চ মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিপিএসের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। প্রতিষ্ঠানটির টার্গেটে ছিল দিনমজুর, চায়ের দোকানদার, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ। গ্রাহক বৃদ্ধির জন্য আজাদ বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্যাকেজ ও প্রণোদনা ঘোষণার মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতেন। বেশ কিছু গ্রাহককে উচ্চ মুনাফায় লোন দেয়া হয়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দিতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রাহকদের সংগৃহীত অর্থ নিজস্ব ও অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ৫০-৭০ কোটি টাকার মধ্যে। তবে গ্রাহকদের তথ্য মতে, সংগৃহীত টাকা পরিমাণ আরও বেশি। প্রলোভনে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে আজাদের নামে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন থানায় ৬০টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে ৩৬টি মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে। গ্রেফতার আজাদ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করে। ছাত্রাবস্থায় ইটের ভাটার ব্যবসা, ঠিকাদারি ব্যবসা, কুষ্টিয়ার একটি স্থানীয় পত্রিকার প্রচার সম্পাদক ও একটি জাতীয় পত্রিকার আঞ্চলিক প্রতিনিধি ছিলেন। ২০০৩ সালে দৌলতপুরে জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে প্রতিষ্ঠান চালু করেন। পরে বৃহৎ পরিসরে জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ান। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৪০টির মতো অফিস চালু করেন। এছাড়াও তিনি ঠিকানা লিভিং লিমিটেড নামে আরও একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ফ্ল্যাট তৈরি করে ক্রয়-বিক্রয় করতেন। প্রতিষ্ঠানের নাম করে কুষ্টিয়াতে ১৫ বিঘা জমি, একটি ৬ তলা বিশিষ্ট ভবন, একটি ইটের ভাটা ও রাজশাহীতে ১১ বিঘা জমি ক্রয় করেন। আত্মসাৎকৃত অর্থ দিয়ে তিনি ঢাকার উত্তরায় বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও গাড়ি ক্রয় করেছেন। তার স্ত্রীর নামে পোস্ট অফিসে ২০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে এবং একটি প্রাইভেট ব্যাংকে তার ২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এছাড়াও নামে বেনামে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।