একের পর এক হাওরডুবিতে দিশেহারা কৃষক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৫ পিএম, ২২ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৪৭ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার দাড়াখাল পাঠার হাওরে পাঁচ কেদার জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন পাড়ারগাঁও গ্রামের কৃষক আবুল খয়ের। বাড়ির একটি গরু বিক্রি করে তিনি খরচের জোগান দেন। আশা ছিল, খেতের ধান তুলে একটি গাভি কিনবেন। ধান উঠলে তাঁর আর বাইরে থেকে চাল কিনতে হবে না। ঘরের ধান দিয়ে চারটে ভাত খেতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সে আশায় গুড়ে বালি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কোন্দানালা এলাকায় বাঁধ ভেঙে হাওরটি তলিয়ে গেছে। হাওরের অন্তত তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন জগন্নাথপুর, শান্তিগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার কৃষকেরা। উজানে পাহাড়ি ঢলের পানিতে সোনার ফসলডুবিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন আবুল খয়েরের মতো কৃষকেরা।
কৃষক আবুল খয়ের বলেন, ‘৫ কিয়ার জমিই ছিল আমার সম্বল। খেত করেই আমার সংসার চলে। আশা ছিল, খেতের ধান তুলে একটি গাভি কিনব। আর সারা বছর ঘরের ভাত খাব।’
দাড়াখাল পাঠার হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের কোন্দানালা এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকছে। উজানের পানিতে সাদা হয়ে গেছে পুরো হাওর। তার মধ্যে সোনালি ধানের ঝিলিক খুঁজে নৌকা দিয়ে কয়েক কৃষক ধান তোলার চেষ্টা করছেন।
ধান তোলার ফাঁকে ছাতক উপজেলার শক্তিরগাঁও গ্রামের কৃষক ইদ্রিস আলী বলেন, আট কেদার জমিতে তিনি ধানের আবাদ করেছিলেন। পানির নিচ থেকে এক কেদার জমির কিছু ধান তুলতে পারলেও বাকি ধান তোলা সম্ভব হয়নি। তাঁর স্ত্রী ফুলমালা বেগম ধান তোলার কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করছিলেন। তিনি বলেন, মুহূর্তেই হাওরে পানি ঢুকে তাঁদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এ বছর কীভাবে চলবেন, বুঝতে পারছেন না।
ভাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন বলেন, সুরমা ও মহসিংহ নদের মিলনকেন্দ্র দাড়াখাল পাঠার হাওর। হাওরে জগন্নাথপুর উপজেলার সাদীপুর, পাড়ারগাঁও, মোল্লারগাঁও, বলবল ও বালিকান্দি; ছাতক উপজেলার শক্তিরগাঁও, গুয়াসপুর, গোপালপুর, শ্রীমতপুর, হায়দরপুর, মোড়লপুর ও আসামপুর এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার হলদারকান্দি, শ্রীরামপুর, ইশাকপুর গ্রামের কৃষকদের জমি আছে। বাঁধ ভেঙে হাওরের সব ধান তলিয়ে গেছে। শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সীতাংশু রঞ্জন ধর বলেন, হাওরে তিন উপজেলার অন্তত তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব ধান রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় কৃষকেরা ক্ষুব্ধ।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুর রহমান বলেন, ছয়টি হাওরের ফসল হারিয়ে উপজেলার কয়েক শ কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দ্রুত তালিকা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দরকার।
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে উপজেলার ছয়টি হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার- দুই দিনে হাওরের ফসল সব তলিয়ে যায়। হাওরগুলো হলো- জগন্নাথপুর উপজেলার মীরপুর ইউনিয়নের হাপাতির হাওর, সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়নের আহমাদাবাদ বাঁধ হুনদা বিল হাওর, উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের শেওড়ার বন ও রমাপতিপুর পশ্চিমের গলাকাটা হাওর, পাটলী ইউনিয়নের সমসপুর হাওর ও সর্বশেষ দাড়াখালের পাঠার হাওর।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, ছোট ছোট ছয়টি হাওরেই কৃষকেরা বোরো আবাদ করেছিলেন। উজানে পাহাড়ি ঢলে হাওরডুবির ঘটনায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নিরূপণে কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ছোট ছোট কয়েকটি হাওরের বাঁধ উপচে সামান্য ক্ষতি হলেও বড় হাওরগুলো এখনো টিকে আছে। তিনি বলেন, দ্রুততার সঙ্গে হাওরের ধান কাটা চলমান। তিন-চার দিনের মধ্যে কৃষকের সব ফসল ঘরে উঠবে।
২৫০ হেক্টর জমির কাঁচা ধান পানির নিচে: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সাভার ও আশুলিয়ার কৃষি খাতে। অসময়ে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ২৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান। এতে বাধ্য হয়ে কাঁচা ও আধাপাকা ধান কেটে নিতে শুরু করেছে কৃষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে ভাটি অঞ্চলের কৃষকদের ঘন ঘন এ ধরণের সমস্যায় পড়তে হবে। এ কারণে এখনই গবেষণার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
আজ শুক্রবার সকালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, আশুলিয়ার সুবন্দি ও শ্রীপুরসহ আশপাশের এলাকার প্রায় এক হাজার কৃষক এক ফসলি নিচু জমিগুলোতে বছরের পর বছর ধান চাষ করে আসছেন। প্রায় তিন-চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এসব জমিতে এ বছর ধান আবাদ হয়েছে। চৈত্র মাসে হঠাৎ নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধিতে তাদের সব ফসল তলিয়ে গেছে। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। একই অবস্থা সাভারের আমিনবাজার, কাউন্দিয়া, আশুলিয়া ও ইয়ারপুর ইউনিয়নে।
আশুলিয়ার সুবন্দি এলাকার কৃষক আব্বাস আলী এবার দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে তার ক্ষেতের সব ধান। কোনো রকমে এক বিঘা জমির আধাপাকা ধান কেটে তুলতে পারলেও বাকি ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
আব্বাস আলী বলেন, গত ২০ বছরেও আমরা চৈত্র মাসে এমন পানি দেখি নাই। কোথা থেকে পানি আসল কেউ বলতে পারে না। এলাকার মুরব্বিরাও এ সময়ে এমন পানি দেখে নাই। সন্ধ্যার পর আর অনেক রাতে দু'বার জোয়ার আসে। তখন ধান পানির নিচে থাকে। আর দিনের বেলা পানি কমে গেলে ধানের শীষ দেখা যায়। এ এলাকার প্রায় সবার ধান ক্ষেতের একই অবস্থা। এক বিঘা জমির ধান কাটতে আমার ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
সুবন্দি এলাকায় পানির কারণে আধাপাকা ধান কেটে এনে মাড়াই করতে দেখা যায় কৃষক সুরুজ মিয়াকে। চার পাকি (বিঘা) জমির সব ধানের গাছ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চোখেমুখে তার বিষাদের ছাপ। জানতে চাইলে সুরুজ মিয়া বলেন, প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ করে ৪ পাকি জমিতে ‘২৮ ধান’ ও ‘হিরা’ ধান লাগাইছিলাম। আর ১৫-২০ দিন গেলেই ধান পাইকা যাইতো। কিন্তু হঠাৎ উজানের পানি আইসা নামায় ঢুইকা পড়ছে। আমার পুরা ক্ষেত ডুইবা গেছে। কোনো রকমে দেড় পাকি জমির ধান আধাপাকাই কাইটা আনছি। এখন সেই ধান মাড়াই করতাছি। এমনিতেই তো সব শ্যাষ হইয়া গেছে তার ওপর কামলা খরচ দিয়া আবার কাঁচা ধান কাইটা আনা লাগতাছে।
সুবন্ধী এলাকার আরেক কৃষক কবির মিয়া বলেন, ধান আনছি অর্ধেক কাঁচা অর্ধেক পাকা। দুই দিন ধইরা কাইটা জাগ দিয়া রাখছি দেইখা একটু পাকছে। এছাড়া ওই এলাকার আরেক কৃষক মো. রহমত আলী ধান কাটার জন্য শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, এখন কামলাগো (শ্রমিক) অনেক দাম। আমাগো বিঘা জমির মত ধান পানিতে ভাসতাছে কিন্তু কামলা পাইনা। যাও পাই চড়া দাম তাগো। ধান কাটার মৌসুম ছাড়া ৬'শ টেকা অইলেই ধান কাটার কামলা পাওয়া যায়। এইবার ১ হাজার ৫শ’ টেকা দিয়াও কামলা পাইতাছি না। তাই নিজে নিজেই যা পারতাছি ক্ষেত থিকা ধান কাইটা নিয়া আইতাছি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাভারে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮৫ হেক্টর। এর মধ্যে ৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ করেন কৃষকরা। আবাদের আওতায় আসা ২৫০ হেক্টরের বেশি জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। সাভার উপজেলা কৃষি অফিসার নাজিয়াত আহমেদ বলেন, হঠাৎ জোয়ারের পানি তুরাগ নদ দিয়ে আমিনবাজার, কাউন্দিয়া, আশুলিয়া, ধামসোনা ও ইয়ারপুর ইউনিয়নের কিছু অংশে প্রবেশ করায় ২৫০ হেক্টরের বেশি জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ধানটা এমন অবস্থায় আছে যে এখনও কাটার মতো অবস্থা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমরা দেখছি যে এরকম জোয়ারের পানি নরমালি আসে না। কিন্তু এবার পানিটা অনেক আগে চলে আসছে। যে কারণে ধানের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। জোয়ারের পানিটা আমিনবাজার ও কাউন্দিয়া বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে এমনভাবে আসে যে এটাকে বাঁধ দিয়ে আটকানো সম্ভব না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটা আমরা দেখবো।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দীন রুনু বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় নিম্নাঞ্চল বা ভাটি এলাকার নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে সমন্বিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব সমাধানের জন্য গবেষণার প্রয়োজন, তা না হলে ভবিষ্যতে এটি জটিল আকার ধারণ করবে।