কমলনগরে ভূমি অফিসের যোগসাজশে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:০০ পিএম, ১০ এপ্রিল,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:০৯ এএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের ফজুমিয়ারহাট বাজারে সরকারি খাস জমি দখলের মহাউৎসব চলছে। উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের নাকের ডগায় সরকারের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন একটি সিন্ডিকেট চক্র। প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকাবাসী। ভূমি অফিসের যোগসাজশে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হচ্ছে ফজুমিয়ারহাট বাজারে। দখল বাজ চক্রটি সরকারের আইন আদালত ও নীতিমালার কোন তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে গড়ে তুলেন কয়েকটি বিশাল বিশাল মার্কেট।
নেপথ্যে রয়েছে উপজেলা ও স্থানীয় ভূমি অফিস। এরা টাকার বিনিময়ে সরকারের এই সব মুল্যবান জায়গা দুই পরিবারের ছেলে মেয়ে ভাই ভাতিজা ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে নামে বেনামে বন্দোবস্ত দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। উপেক্ষিত ঐ বাজারের গরীব অসহায় ও ভূমিহীন ব্যবসায়ীরা। যে যার মতো করে দখল বানিজ্যে মেতে উঠেছে তারা। এই চক্রটির কাছে প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়েন। এরা সরকারি খাল ও বাজারের গলি ভরাট করে এই সব জমির উপর গড়ে তুলেন আলিশান প্রাসাদ। সরকারী জমিতে দোকান ভিটি নির্মাণ করে অন্যদের কাছে আবার এই জায়গা বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্ধ কোটি টাকা। "সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢালদে " অবস্থা চলছে ফজুমিয়ারহাট বাজারে। যেন দেখার কেউ নেই।
সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের ফজুমিয়ারহাট বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এই বাজারের এক তৃতীয়াংশ দোকান ভিটি দুটি পরিবারের দখলে রয়েছে। দুই পরিবারকে ২৫ টি দোকান ভিটি বন্দোবস্ত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে উপজেলা ভূমি অফিসের বিরুদ্ধে। এঘটনায় গোটা এলাকাব্যাপী চলছে সমালোচনার ঝড়। দুই পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে ২৫টি ভিটি বন্দোবস্ত নেওয়ার পরেও এখনো প্রায় ১৫ টি ভিটির জমি অবৈধ দখল করে রেখেছেন তারা।
এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে ফজুমিয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা ফজলে এলাহী শামিম, বেলাল হোসেন, উম্মে হানী হিরন, আব্দুল মালেক, হেলাল উদ্দীন ও মোঃ মোস্তফা বাদী হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগে উল্লেখ করেন যে, ওই এলাকার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হোসেন হাওলাদার ও তার ছেলে আকবর হোসেন আরজু হাওলাদার, হারুনুর রশীদ হাওলাদার, আক্তার হোসেন বিপ্লব হাওলাদার, শাহাদাত হোসেন শামীম হাওলাদার, আব্বাস উদ্দিন সুমন হাওলাদার, শওকত হাওলাদার এবং হোসেন হাওলাদারের দুই স্ত্রীর নামে ১০টি ভিটি বন্দোবস্ত দেন উপজেলা ভূমি অফিস। হোসেন হাওলাদারের কয়েকজন ভাতিজার নামে আরো ৭ টি ভিটি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এছাড়া বসির উল্লাহ মিয়ার ছেলে মোহাম্মদুল্লাহ মিয়া ও তার এক ছেলে মনিরুল ইসলাম রিপু,দুই ভাই-স্ত্রী-ভাতিজা সহ তাদের এক পরিবারের নামে প্রায় ১০ টি দোকান ভিটি বন্দোবস্ত দেন ভূমি অফিস। এসব দোকান ভিটি একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে তারা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে আবার ঐ দোকানগুলো অন্য লোকজনের নিকট বিক্রি করে দেন। সরকারী জমি একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।
উপজেলা প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে সরকারী জমি যে যেভাবে পারছেন, দখল করে তা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিচ্ছে।
ফজুমিয়ারহাট বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ফজুমিয়ারহাট বাজারটি সরকারের খাস জমিতে অবস্থিত। অসহায় ভুমিহীনদের মাঝে এই সব জমিগুলো বন্দোবস্ত দেওয়ার বিধান থাকলেও ফজুমিয়ারহাটে এই নিয়ম মানা হয়নি। এলাকার স্বচ্ছল এই পরিবারের লোকজন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাজারের এক তৃতীয়াংশ দোকানঘর বন্দোবস্ত নিয়ে যায়।
এক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে এসব দোকানঘরগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বাকী দোকান ভিটিগুলো বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্যও গোপন পাঁয়তারা করছেন এই দুই পরিবারের লোকজন। এদের দখল বানিজ্য দেখে মনে হয়, রক্ষক এখন ভক্ষকে পরিনত হয়েছে। দখলবাজরা দখল করছে। আর রক্ষকরা দেখে যাচ্ছে। সরকারি জায়গা উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের কোন তৎপরতা চোখে পড়েছেনা।
অথচ ফজুমিয়ারহাট বাজারটি ঐ এলাকার জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার। এই বাজারে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত বা চলাচল। দীর্ঘদিন থেকে বাজারে একটি টলঘর ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণের দাবী তুলে আসছেন এলাকাবাসী ও বাজার ব্যাবসয়াীরা। বাজারের ব্যবসায়ী,ক্রেতা-বিক্রেতাদের দাবী উপেক্ষা করে সরকারের এসব খাস জমিগুলো টাকার বিনিময়ে দুইটি প্রভাবশালী পরিবারকে ২৫ টি দোকান ভিটি বন্দোবস্ত দেয় স্থানীয় ভূমি অফিস। টলঘর ও পাবলিক টয়লেটের জায়গা না রেখে এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। তারা এবিষয়ে জেলা প্রশাসকের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাওলাদার পরিবার ও মোহাম্মদুল্লাহ মিয়া পরিবারের ছেলে-মেয়ে ভাই-ভাতিজা সহ দুই পরিবারের আত্মীয় স্বজনের নামে ২৫ টি ভিটি বন্দোবস্ত নিয়েও তারা আরো প্রায় ১৫ টি ভিটির জমি দখল করে রাখেন।
অন্যদিকে ফজুমিয়ারহাট বাজারের অবৈধ দোকান ভিটিগুলো স্থানীয় এসিল্যান্ড পুদম পুষ্প চাকমার নেতৃত্বে উচ্ছেদ করার পর আবার অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ঐ জমিতে দোকান ভিটি নির্মাণ করা হয়।এতে প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়! দিনের বেলা অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়।রাতের বেলায় আবার দোকানঘর পুনর্নির্মাণ করা হয়। উপজেলা প্রশাসনকে কোন মুল্যই দিচ্ছেনা চক্রটি।
গরীব অসহায় পরিবারগুলোকে বঞ্চিত করে উপজেলা ভূমি অফিস এসব কথিত প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে মেয়ে স্ত্রী সহ আত্মীয় স্বজনদের নামে সরকারী খাস জমিতে ২৫ টি দোকান ভিটি বন্দোবস্ত দেওয়া নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
স্থানীয়দের প্রশ্ন এতোগুলা দোকান ভিটি এই দুই পরিবারের নামে কিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়? অথচ ভুমিহীন অসহায় ব্যবসায়ী মানুষগুলোকে উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে এসব অনিয়ম করা হয় বলে দাবী করেন স্থানীয়রা। এসব ভিটিগুলো নেওয়ার পরেও অতিরিক্ত আরো ১৫ টি ভিটির জায়গা মোহাম্মদুল্লাহ মিয়া ও হাওলাদার পরিবার দখল করে রাখেন।
অভিযুক্ত হোসেন হাওলাদারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মোহাম্মদুল্লাহ মিয়ার ছেলে মনিরুল ইসলাম রিপু জানান,এখানে আমাদের রেকর্ডীয় সম্পত্তি রয়েছে। সরকারী জমিতে আমাদের নামে কয়েকটি ভিটি আছে। বাকী ভিটিগুলো নেওয়ার জন্য আমরা আবেদন করে রেখেছি। আমরা সার্ভেয়ারকে বলেছি আমাদের রেকর্ডিয় জমিগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শুনতে রাজি নয়।
ফজুমিয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা,কমলনগর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ভিপি নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন,দুই পরিবারের নামে এতোগুলা দোকান ভিটি বন্দোবস্ত কিভাবে দেওয়া হয় তা আমারও প্রশ্ন। এই ভিটিগুলো পাওয়ার যোগ্য গরীব অসহায় ব্যবসায়ীরা।কিন্ত তারা পাননি। পায় রাঘব বোয়ালরা। দিনের বেলা প্রশাসন এসে উচ্ছেদ করে। আর রাতের বেলায় আবার দোকান নির্মাণ করা হয়। এই হলো আমাদের প্রশাসনের অবস্থা। মনে হয় কমলনগরের প্রশাসন এই দুই পরিবারের নিকট খুব অসহায়। তিনি এসব অবৈধ দোকান ভিটি দখলমুক্ত করে গরীব অসহায়দের মাঝে বন্দোবস্ত দেওয়ার দাবী জানান।
স্থানীয় চরকাদিরা ইউনিয়ন ভুমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহসিলদার) মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, এগুলো আমার আগেই বন্দোবস্ত দেওয়া। দুই পরিবারের নামে কেন এতো দোকান বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেজন্য ডিসি স্যারের অফিস থেকে এসব বন্দোবস্ত নথিগুলো ফেরত পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)পুদম পুষ্প চাকমার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন,সরকারী জমি দখল করে কেউ পার পাবেনা। এক পরিবার একটির বেশী দোকান ভিটি পেতে পারে না।গরীব ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।