পিতৃপরিচয়ের অভাবে যৌনপল্লীর শিশুদের জন্মনিবন্ধনে জটিলতা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৫ পিএম, ১৬ মার্চ,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:৪৭ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বাবার পরিচয় না থাকায় জন্মনিবন্ধনে জটিলতা দেখা দিয়েছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের। অস্থায়ী অভিভাবক দ্বারা শিশুদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হলেও ভবিষ্যতে ওয়ারিশ জটিলতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাজবাড়ী গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া যৌনপল্লী দেশের বৃহৎ যৌনপল্লী। এখানে ১ হাজার ৩শর বেশি পেশাদার যৌনকর্মীসহ প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার যৌনকর্মীদের গর্ভে সন্তান জন্ম হলেও বাবার ঠিকানা নেই সেসব শিশুদের। ফলে অভিভাবকহীন শিশুদের জন্মনিবন্ধনে জটিলতা দেখা দিয়েছে। যদিও বর্তমানে প্রশাসন, যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অস্থায়ী অভিভাবক দ্বারা জন্মনিবন্ধন করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন, জনপ্রতিনিধি ও অস্থায়ী অভিভাবকরা। এছাড়া অস্থায়ী অভিভাবকরাও রয়েছেন ওয়ারিশ জটিলতায়। কারণ এই নিবন্ধনের মাধ্যমে যৌনপল্লীর শিশুরাও তার ওয়ারিশ হচ্ছে। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর যৌনকর্মী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে পায়াকট বাংলাদেশ, মুক্তি মহিলা সমিতি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, কেকেএসসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাগুলোর জরিপ অনুযায়ী, যৌনপল্লীতে ০ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২০০ জন। ওই সকল শিশুর জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হলে বাবার নাম না থাকায় দেখা যায় জটিলতা। পরবর্তীতে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও অস্থায়ী অভিভাবক দ্বারা জন্মনিবন্ধনের জটিলতা দূর হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ বর্তমানে যারা যৌনপল্লীর ওইসব শিশুর অভিভাবক হচ্ছেন, জন্মনিবন্ধন সূত্রে ভবিষ্যতে তাদের ওয়ারিশ হবে ওই শিশুরা। ফলে তাদের ঔরসজাত সন্তানের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যৌনপল্লীর শিশুরাও অস্থায়ী ওই অভিভাবকের সম্পত্তির ওয়ারিশ হচ্ছে। আবার এসব শিশুর উচ্চশিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রেও অভিভাবকের প্রয়োজন হবে। তাই অনেকের মতে যৌনপল্লীতে যৌনকর্মীদের রেজিস্ট্রি অনুযায়ী বিয়ের ব্যবস্থা করা হলেই দূর হবে যৌনপল্লীর শিশুদের অভিভাবক জটিলতা।
যৌনপল্লীর শিশুরা জানায়, তারা বড় হয়ে চাকরিসহ ভালো কাজ করতে চায়। এজন্য তাদের জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন। যৌনপল্লী নিয়ে কাজ করা শেখ রাজিব বলেন, জন্ম নিবন্ধন এখন অনলাইনে হচ্ছে। ওইখানে বাবার নাম না দিলে সম্পূর্ণ হয় না। যে কারণে তিনি একটি বাচ্চার অভিভাবক হয়েছেন। কিছুদিন পর হয়তো তিনি সেখানে থাকবেন না। কিন্তু ওই বাচ্চা বড় হলে নানা কারণে অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে। তখন সে কোথায় পাবে এসব।
তিনি আরও বলেন, তার জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তিনি যে বাচ্চার অভিভাবক হয়েছেন, সেই বাচ্চা কিন্তু ওয়ারিশ সূত্রে তার সম্পত্তির মালিক হয়ে গেলো। ফলে ওই বাচ্চা ও তিনি উভয়ই সমস্যার মধ্যে পড়ছেন। যে কারণে তিনি আর কোনো বাচ্চার অভিভাবক হচ্ছেন না। এ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি মনে করেন, এখানে সন্তান জন্মের আগে ওই ব্যক্তির (বাবা) জাতীয় পরিচয়পত্র ও ঠিকানা রাখা অথবা কথিত বিয়ের ব্যবস্থা বাতিল করে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে যৌনপল্লীতে অভিভাবক জটিলতা দূর হবে। বেসরকারি সংস্থা পায়াকট বাংলাদেশ দৌলতদিয়ার ম্যানেজার মজিবুর রহমান খান জুয়েল বলেন, তাদের তালিকা অনুযায়ী যৌনপল্লীতে ০ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২ শতাধিক। তাদের নিবন্ধনের জন্য তার সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন আবেদন করেছে। এজন্য ইউনিয়ন পরিষদকে আন্তরিক হতে হবে। বাবার নামের জন্য বিয়ের সময় রেজিস্ট্রেশন করা হলে এ সমস্যা থাকবে না। মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম বলেন, শুরুতে যৌনপল্লীর বাচ্চাদের জন্ম নিবন্ধনে জটিলতা ছিল। কিন্তু এখন অনেকটা কম। তবে এখনও অনেক বাচ্চার নিবন্ধন বাকি আছে। আসলে এখানকার বাচ্চাদের বাবার পরিচয় পাওয়া খুব কষ্টকর। কারণ যৌনপল্লীতে বিভিন্ন স্থানের মানুষ আসা যাওয়া করে। আর যৌনকর্মীদের অনেক কথিত স্বামী আছে। যার কারণে বাচ্চাদের বাবার পরিচয় পাওয়া যায় না।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মন্ডল বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এরইমধ্যে যৌনপল্লীর প্রায় ৬০ শতাংশ বাচ্চা নিবন্ধনের আওতায় এসেছে। এ নিবন্ধনে অস্থায়ীভাবে বিভিন্নজন অভিভাবক হয়েছে। সঠিকভাবে জন্মনিবন্ধন করতে হলে বাবা-মার পরিচয় লাগে। সেখানে জটিলতা আছে। তারপরও প্রশাসনের সহযোগিতায় সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে মনে করছি।
তিনি বলেন, যারা অস্থায়ী অভিভাবক হয়েছেন, তারা হয়তো কিছুদিন পর থাকবেন না। ফলে ভবিষ্যতে কী হবে বলতে পারছি না। তবে অভিভাবক হলে নিয়ম অনুযায়ী তারা ওয়ারিশ হচ্ছে। এটা বড় একটা সমস্যা। এ বিষয়ে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাহাবুর রহমান শেখ বলেন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এবং বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী কোনো তথ্য না থাকলে অপ্রাপ্ত লিখে নিবন্ধন করা যাবে, সেটি বিধানে আছে। এরইমধ্যে যারা অস্থায়ী অভিভাবক হয়েছেন ওয়ারিশ হিসেবে তার সম্পত্তি ওই শিশুরা পাবে কিনা সেটা আদালতে মীমাংসা হবে।