নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জে মা-মেয়ে হত্যা মেধাবী ছেলের নৃশংসতায় নির্বাক পরিবার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:৪৭ পিএম, ৩ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:২২ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ষাটোর্ধ্ব আলাউদ্দিন মিয়া ও তার স্ত্রী শায়লা বেগমের একমাত্র সন্তান জুবায়ের। বাড়িতে তার ডাক নাম স্বপনীল। একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবা মায়ের অতি আদুরে সন্তান সে। ছোট বেলা থেকেই পড়া-লেখায় যর্থেষ্ট মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছেলে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে স্বপনীল।
ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তো সে। তার লেখা-পড়ার রেজাল্ট ঘিরে পরিবারের স্বপ্ন বিশালতায় রূপ নেয়। তারা স্বপ্ন দেখেন একদিন ছেলে তাদের মুখ উজ্জল করবে। ভালো চাকরী করবে।
সমাজের প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ বলবে মেধাবী ও যোগ্য সন্তানের বাবা-মা আলাউদ্দিন ও শায়লা বেগম। কিন্তু কে জানতো তাদের সেই স্বপ্ন অংকুরে বিনষ্ট হয়ে যাবে। এখন মানুষ তাদের বলছে, খুনির বাবা-মা। এতে একদিনে লজ্জা আর ঘৃণা অন্যদিকে ছেলের এমন নৃসংশকান্ডে নির্বাক তারা। সাথে আত্মীয়-স্বজনরাও। কিন্তু কেন জুবায়ের এমন ঘটনানো ঘটালো?। এমন প্রশ্নও এলাকারবাসীর মুখে মুখে।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) বিকেলে শহরের নিতাইগঞ্জে ডালপট্টি এলাকায় স্বপন দাসের মালিকানাধীন ৬ তলা ভবনে মা ও মেয়েকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে জুবায়ের। নিহতরা হলো রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও তার মেয়ে ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তী (২২)। দুইজনের মধ্যে একজনের মরদেহ পড়েছিল মেঝেতে ও অপরজনের মরদেহ অর্ধেক খাটের উপর।
এসময় ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা ছুরিসহ জোবায়েরকে এলাকাবাসীর সহায়তায় আটক করে পুলিশ। এবং জোবায়েরের ব্যাগ থেকে দুটি সোনার চেইন ও কানের দুল উদ্ধার করা হয়। টাকা ও সোনাদানা লুট করতে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে জুবায়ের স্বীকার করেছে, জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে নগরের পাইকপাড়া বড় বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পুরো বাড়ি জুড়ে নিরবতা। পৈতৃক সম্পতির এক শতাংশ জমির উপর নির্মিত বসতবাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন আলাউদ্দিন মিয়া। টানবাজারে লবণ ব্যবসা করতেন। করোনাকালে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় ব্যবসা নেই বললেই চলে।
আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় নিজের সংসার চালাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আর্থিক অনটনে পড়ে থমকে যায় জুবায়েরের পড়াশোনা। করোনার পূর্বে টিউশনি করে নিজের আর্থিক চাহিদা পূরণ করলেও করোনার সময় তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
২০২০ সালের শেষে ধার-দেনা করে ঔষধ বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এ ব্যবসায় বিপুল ক্ষতি হয় তার। ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে ঋণদাতার কাছে বিভিন্ন সময় নানা কটুক্তি শুনতে হয়। আত্মগ্লানিতে একসময় বাড়ি থেকে বের হওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন জুবায়ের।
জুবারের মা শায়লা বেগম ছেলের ছবির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন। আর নিরবে চোখের জল ফেলছেন। ছেলে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে, পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ও কিভাবে এই কাজ করতে পারে আমি বুঝতাছিনা।
মঙ্গলবার দুুপুর ২টা বাজে না খেয়ে বের হয়ে যায়। আমি ফোন দেই। ফোনে বলল, ‘আমি আসতাছি, এসে খাবো’। একটু পরে ওর বাবা আইসা বলল, পুলিশ বলছে ও নাকি কাউরে খুন করছে।
কান্না জড়িত কন্ঠে শায়লা বেগম বলেন, আমাদের সংসারে আর্থিক সমস্যা ছিল কিন্তু আমরা মোটামোটি ভালোই ছিলাম। ও (জুবায়ের) টাকা চাইলে আমরা টাকা দিতাম। আর অনেক বেশি টাকা চাইতো না। কিন্তু ও একটা ঔষধের ব্যবসা করছিল। ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় অনেক টাকা ঋণে পড়ছে।
গতবছর টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও এখনো পরিশোধ করতে পারে নাই। এসব (পাওনাদার) মানুষের সাথে দেখা হলে বিব্রত হইত, এজন্য বাড়ি থেকেও কম বের হইতো। ইদানিং কেমন যেন হয়ে গেছে। আগে আমাদের সাথে খাবার খাইতো। কিন্তু এ কয়দিন যাবৎ উপরের রুমে একা থাকে, মেজাজ খিটে খিটে থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ করতেছিল।
আলাউদ্দিন মিয়া নিজের অসয়াত্ব প্রকাশ করে বলেন, আর কি বলার আছে, মান সম্মান যা ছিল সব শেষ। একটা মাত্র ছেলে আমার। ছেলে হারাইলে কি থাকব আর জীবনে। আমার ছেলের কোন ধরনের বাজে অভ্যাস ছিল না। কারো সাথে উঁচু শব্দে কথাও বলে না। নামাজ পড়া ছাড়া খুব বেশি বাহিরেও যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রতিবেশী বলেন, জুবায়ের আহলে হাদিস করত। ধর্মের মতাদর্শ নিয়ে মাঝেম ধ্যে মানুষকে বুঝাতো। এছাড়া পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করত। আমরা প্রথমে বিশ^াস করতে পারিনি। খবরে ওর ছবি দেখে সবাই অবাক হয়ে পড়ে।
এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু বলেন, ‘জুবায়েদকে আমরা ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সে স্বীকার করেছে তাঁর নিজের চলার জন্য টাকার দরকার। এ কারণে বড় বাড়িটি তিনি টার্গেট করেন। ছয়তলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে কলবেল বাজিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের কেউ দরজা খোলেননি। তখন পাশের রামপ্রসাদ চক্রবর্তীর ফ্ল্যাটে কলবেল চাপেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটের দরজা খুললে ভেতরে ঢুকে রুমা চক্রবর্তীর গলা চেপে ধরেন জোবায়ের।
এ সময় রুমার গলার হার তিনি ছিনিয়ে নেন। এরপর ছুরি মেরে রুমাকে হত্যা করেন। রুমার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তী এগিয়ে এলে তাঁকেও ছুরি মেরে হত্যা করে।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত জোবায়েরকে আসামি করে নিহতরুমা চক্রবর্তীর স্বামী রামপ্রসাদ চক্রবর্তী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। জোবায়েরের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।