অস্তিত্ব সঙ্কটে চলনবিলের ১৬ নদ-নদী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:১৬ পিএম, ১ মার্চ,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:২৭ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। তেমনি নাটোরের গুরুদাসপুর ও চলনবিলের প্রধান নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানীসহ ১৬টি নদ-নদীতে পানি শুকিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে পানি দেখা গেলেও বর্ষা শেষে আর থাকে না। দখল, দূষণ আর ভরাটে অস্তিত্ব সংকটে নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় মরে যাচ্ছে চলনবিলের নদী। পানির অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষি জমির সেচকার্য্য ব্যহত হবার পাশাপাশি দেশি মৎস্য সম্পদ জীব-বৈচিত্র হুমকির মুখে। নদীকে জীবিকা করে খাওয়া মানুষগুলো বেকার হয়ে পড়েছে। এছাড়া স্থবিরতা নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। তবে উপজেলার সাবগাড়ী এলাকায় একটি রাবারডাম স্থাপনের কারণে নদীর কয়েক কিলোমিটার জুড়ে এখনও পানি রয়েছে। আর এক মাস পরে রাবারড্যাম নামিয়ে দিলে সে পানিও থাকবে না।
এক সময় নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্য কেন্দ্র গুরুদাসপুর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে নদী পথের সঙ্গে ও সহজলভ্য অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ নৌ যোগাযোগে ব্যবসা বাণিজ্য চলেছে। নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে থাকা নন্দকুজা ও আত্রাই নদী সৌন্দর্য্য, পূর্ব জৌলুশ ও স্বকীয়তা হারিয়ে খালে পরিনত হয়েছে। জল পথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও বর্তমান সময়ে এলাকার সব জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিক খরচে ব্যবসায়ীদের স্থল পথে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্য জানা গেছে, প্রায় ২৯ বছর আগেও চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌচলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে।
চলনবিল অঞ্চলের জেলে আব্দুল বারেক, মুন্সি মালেক, আব্দুর রহিম মোল্লাসহ অন্তত দশজন কৃষক বলেন, প্রায় ২৫ বছর ধরে তারা পেশা বদলেছেন। চলনবিলের নদ-নদীগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে। এ কারণে ভরা বর্ষাতেও পানি থাকেনা। একসময় বিল-জলাশয়, নদীকে জীবিকা করে তারা দিনাতিপাত করছেন। কিন্তু এখন তারা পেশা বদলে বিকল্প নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন বেঁচে থাকার তাগিদে।
চলনবিল অঞ্চলের কৃষক বরেক আলী, আব্দুস সোবহান ফকির, মনিরুল ইসলাম জানান, নদীর পানিতে তারা শুস্ক মওসুমজুড়ে সেচ সুবিধা পেতেন। এতে করে ফসলে উৎপাদন খরচ কম হতো। কিন্তু এখন আর নদীর পানিতে সেচ দেওয়া যায় না। এ কারণে বাড়ে ফসলের উৎপাদন খরচ। কিন্তু বিক্রিতে মূল্য পাওয়া যায় না।
পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর ২২২১/২ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিলে ত্যাগ করে। অবশিষ্ট ২৬৯১/২ মিলিয়ন ঘনফুট পলি নদ-নদীসহ চলনবিলে স্থিতি থাকে। অথচ এক সময় এসব নদীতে বছর জুড়েই পানি থাকতো। নদীতে চলাচল করতো ছোট বড় নৌকা। নদী আর নৌকাকে ঘিরে চলনবিলের গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড়, নাজিরপুর, সিংড়ার, বড়াইগ্রামের আহম্মেদপুর, তাড়াশের ধামাইচ, নাদোসৈয়দপুর, চাটমোহরের ছাইকোলা, অষ্টমনিষা, মির্জাপুর ভাঙ্গুড়ায় গড়ে উঠেছিল বড় নৌবন্দর। চলত রমরমা বাণিজ্য। কালের আবর্তমানে সেসব এখন শুধুই ইতিহাস।
গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় মোকামের ব্যবসায়ী আইনুল মোল্লা, আব্দুল্লাহসহ অনেক ব্যবসায়ীরা জানান, তারা এক সময় নৌকায় করে শত শত মণ ধান, পাট, গম সরিষাসহ চলনবিলের সকল কৃষিজাত পণ্য ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে নিয়ে যেত। আবার সেসব মোকাম থেকে নানা পণ্য এখানে এনে পাইকারি দামে বিক্রি করতো। কম খরচে সহজলভ্য পরিবহন সুবিধা ভোগ করলেও এখন আর ওই সুবিধা তারা পান না। এখন শুধু বর্ষাকালের ৩/৪ মাস কোন রকমে নৌকায় পণ্য আনা নেয়া করে থাকেন। ফলে আগের মত আর ব্যাবসায়ীরা ব্যাবসা করতে পারেন না।
নাটোর জেলা আ.লীগের সভাপতি স্থানীয় এমপি আব্দুল কুদ্দুস চলনবিল, নদ-নদী ও খাল-বিল রক্ষায় তিনি সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপের দাবি জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নাটোর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, ৬৪ জেলার খাল নদী জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প ২য় পর্যায়ের আওতায় চলনবিলের ছোট বড় নদী ও খাল সমূহ পুনঃখননের প্রকল্প উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। সেটি অনুমোদিত হলে খননের কাজ শুরু হবে। অপর দিকে নাটোর জেলার প্রধান নদী নারদ, বড়াল ও মুসাখাঁ পুনঃখননের জন্যেও পৃথক একটি প্রকল্প উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।