রাবির কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের ৩২টি যন্ত্রপাতির ২৪টিই অকেজো
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:১৩ এএম, ৩১ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৫৫ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
গবেষণার কাজে ব্যবহৃত কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। তবে সাজানো-গোছানো এ গবেষণাগারটির দুরবস্থা খালি চোখে দেখে বুঝা মুশকিল। ছোট-বড় মিলিয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি রয়েছে মোট ৩২টি। এসব যন্ত্রপাতির প্রতিটির মূল্য ৪০ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকার কাছাকাছি।
তবে এই ৩২টি যন্ত্রপাতির মধ্যে কার্যক্ষমতা রয়েছে মাত্র ৮টির। আর বাকিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। দুরবস্থা এখানেই শেষ নয়। দক্ষ জনবলের অভাবে কার্যকর ৮টি যন্ত্র থেকেও পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়েই কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১২টি অনুষদের মধ্যে ৭টিই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। এই সাতটি অনুষদের অধীনে রয়েছে ২৯টি বিভাগ। এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরাই মূলত গবেষণাগারটি ব্যবহার করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় 'এফটিআইআর' মেশিন যা বছর না যেতেই নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এমনি আরও ৪টি যন্ত্র ২০০৪ সালে কেনা হলেও তা নষ্ট হয়ে আছে বছরের পর বছর।
এছাড়াও ২০১১ সালে ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় 'অটোমেটিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ' এবং ২০১৩ সালে ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় 'এনার্জি ডিস্পেরসিভ এক্সরে ফ্লুরোসেন্স' মেশিন। দুটি যন্ত্রই ৩ বছর না যেতেই ২০১৬ সালে নষ্ট হয়ে যায়। কোটি টাকার ৮টি যন্ত্রসহ আরও ১৪টি যন্ত্র এভাবেই অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যেমন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার থাকার প্রয়োজন ছিল তেমন কোনো গবেষণাগার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। যে গবেষণাগারটি রয়েছে সেখানেও নেই প্রয়োজনীয় কোনো যন্ত্রপাতি। যেগুলো রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই অকার্যকর। ৩২টি মেশিনের মধ্যে ২৪টিই অকেজো। এত অকেজো যন্ত্রপাতি থাকলে গবেষণাগারের আর কি থাকে?
তারা আরও জানান, প্রতিটি মেশিনের জন্য একজন করে ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার কিন্তু সেই পরিমাণ জনবল না থাকার কারণে কার্যকর যন্ত্রগুলোর সুবিধাও পাচ্ছেন না তারা। এছাড়া পরিচিত শিক্ষকরা সেখানে অগ্রাধিকার পায়। আর অফিস সময় পার হয়ে গেলেই বন্ধ করে দেওয়া হয় গবেষণাগারটি। যার ফলে সময়মতো পাওয়া যায় না গবেষণার ফলাফল।
এদিকে, সচল আটটি যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে অটোমেটিক অ্যাবসরপশন স্পেক্ট্রোস্কোপ (এএএস) মেশিন, এফটিআইআর মেশিন, ইনভার্টেড সিস্টেম মাইক্রোস্কোপ, টিজিআর, হট স্টেজ পোলারাইজড মাইক্রোস্কোপ, ইউভি ফিজিবল স্পেকট্রোফটোমিটার, সেন্ট্রিফিউজ উইথ আল্টা কুলিং এবং সিও২ ইনকিউবেটর।
এই নামমাত্র কয়েকটি সচল যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোভাবে চলছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার।
এমন অচলাবস্থার দ্রুত অবসান চান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণার খুব বেশি সচল নয়। এখানকার অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট প্রায়। যার ফলে খুব বেশি গবেষণার কাজ এখানে করা সম্ভব হয় না। আর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে হয়। সেখানে এ ধরনের গবেষণাগারে সঠিকভাবে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটার দ্রুত সংস্কার দরকার বলে মনে করেন তিনি।
তবে জনশক্তির সংকট এবং কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে অনুদানের অভাবকে দুষছেন গবেষণাগারটির পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রতিটি মেশিনের জন্য একজন করে ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার কিন্তু আমাদের সেই পরিমাণ জনবল নেই। তারপরও আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে। পাশাপাশি আমাদের যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি রয়েছে তা যথেষ্ট নয়। যার ফলে অনেক গবেষণার কাজ করতে শিক্ষার্থীদের ঢাকা যেতে হচ্ছে। এছাড়া আমাদের গবেষণায় অনুদান খুব বেশি না থাকায় একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার যেমনটা হওয়া দরকার তা হচ্ছে না।
জানা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মোট ১ হাজার ৯০৮ এবং ২০২২ সালে মোট ১ হাজার ৯৪৮টি গবেষণার স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজ করতে এলে সেম্পল প্রতি দিতে হয় ৫০ টাকা। অনেক সময় কোনো শিক্ষার্থীর ইমার্জেন্সি কোনো স্যাম্পলের ফলাফল পেতে গুনতে হয় ২০০ টাকা।
শুধু তাই নয়, এই স্যাম্পল টেস্ট করাতে এসেও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরিচিত ও প্রভাবশালী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের কাজ আগে করিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া অফিসের সময়ের পর বন্ধ হয়ে যায় গবেষণাগার। অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি।
এ বিষয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক কুদরত-ই-জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার সবসময় খোলা থাকা দরকার। সেখানে দেখভাল করার মানুষ থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগার থাকলেও সেখানে নেই সংরক্ষণের মানুষ। আবার গবেষণাগার অফিস সময়ে চলে যার ফলে আমাদের খুব বেশি কাজ হয় না। একটি স্যাম্পলের রিপোর্ট পেতে অনেক সময় লাগে।
তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ স্বীকার করে পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অফিস সময়ে গবেষণাগার খোলা থাকলেও আমরা মাঝে মাঝে এই সময়ের বাইরেও কাজ করে থাকি। এছাড়া অনেক সময় পরিচিত শিক্ষকরা এসে তাদের কাজ আগে করে দেওয়ার জন্য বলেন, সেখানে অনেক সময় না করা সম্ভব হয় না। তবে এই বিষয়ে যদি শিক্ষকরা আমাকে সহযোগিতা করেন তাহলে আমি স্বচ্ছ থাকতে পারব।
বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারের এমন অচল অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের দাবি জানিয়ে রাবি সায়েন্স ক্লাবের সভাপতি আবিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে মানসম্মত গবেষণা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে যাব। যা শুধু আমাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বরং এটি গোটা জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গবেষণা কার্যক্রমকে আরও বেশি গতিশীল করতে গবেষকদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।