অনিশ্চয়তায় জানুয়ারির বই উৎসব : বই ছাপানোর সিংহভাগই বাকি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫৬ পিএম, ৭ নভেম্বর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২৮ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
২০১০ সালের পর থেকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়। করোনা মহামারির কারণে গত বছর ও চলতি বছর এ উৎসব হয়নি। আগামী বছর বই উৎসব পুরোনো ধারায় ফিরবে বলে আশা করা হলেও বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া যাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর দু’মাসেরও কম। জানুয়ারির প্রথম দিনে বই উৎসব করতে হলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ। এরপর স্কুলে স্কুলে বইগুলো পৌঁছানোর কাজ বাকি থাকবে। আগামী বছর ৩৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে চায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এর মধ্যে মাধ্যমিকেরই রয়েছে ২৩ কোটি বই। সেগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাপানো হয়েছে মাত্র ৫ কোটির কিছু বেশি। অপরদিকে নানা যোগ-বিয়োগ শেষ করে গত ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ। হাতে সময় কম থাকলেও বই ছাপানোর সিংহভাগই এখনও বাকি। যার কারণে জানুয়ারির প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় শঙ্কা। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে বই ছাপানো হলে মান ঠিক রাখা সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছে প্রেস মালিকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, ছাপাখানার পাওনা পরিশোধ না করা, কাগজের কাঁচামাল সংকট, প্রেস মালিকদের অসহযোগিতা, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল ও কাগজসহ বই ছাপানোর অপরিহার্য উপাদানের দামবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি লোডশেডিং এই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের মিল মালিকরাও কৃত্রিম সংকট তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না। তবে এত সংকট-শঙ্কার পরও বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিতে চায় সরকার। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মিল মালিক ও প্রেস মালিকদের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। চুক্তিভুক্ত ছাপাখানাগুলো নির্ধারিত সময়ে বই দিতে ব্যর্থ হলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করাসহ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে এখনও বছরের প্রথম দিনই সবার হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় পাঠ্যবই তৈরিতে কাগজ সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের মিল মালিকরাও কৃত্রিম সংকট তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না। বইয়ের মান নিয়েও আপস করা হবে না জানিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, তড়িঘড়ি করে দেয়ার নামে প্রেস মালিকরা যেন নিম্নমানের বই সরবরাহ করতে না পারেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা কমিটি মাঠ পর্যায়ে তা নিয়মিত মনিটরিং করবে।
তিনি আরও বলেন, বিনামূল্যের বই তৈরিতে প্রতি বছরের শেষের দিকে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। মিল ও প্রেস মালিকদের কাছে এনসিটিবি এক ধরনের জিম্মি হয়ে যায়। সে কারণে বছরের শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে বসে নতুন রূপরেখা তৈরি করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি ও আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। যারা বই ছাপানোর কাজ পেয়েছেন, সবাই ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। প্রতিটি কাজেই এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।
তবে নির্ধারিত সময়ে বই তুলে দেয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি মো. শহিদ সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে সরকার বই দিতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। বলতে গেলে বাজারে কাগজই নেই। চাহিদা থাকার পরও মিলগুলো কাগজ সরবরাহ করতে পারছে না। অন্যদিকে ডলার সংকটে পাল্প আমদানিও কমে গেছে। এই মুহূর্তে কাগজ সংকটই সবচেয়ে বড় বিষয়। এছাড়া টেন্ডার সাবমিটের পর কাগজের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যার কারণে যারা বই ছাপানোর কাজ পেয়েছেন, সবাই ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। প্রতিটি কাজেই এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, যেহেতু চুক্তিবদ্ধ প্রেস মালিকরা লোকসান দিয়ে বই ছাপাচ্ছেন, তাই বইয়ের মান ঠিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। প্রথমত মানসম্মত কাগজ পাওয়া কঠিন। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- ভালো কাগজ পাওয়া গেলেও কতজন প্রেস মালিক সে কাগজ কিনে বই ছাপাবে সেটাও বড় প্রশ্ন। শেষ সময়ে এসে সব খারাপ কাগজ চালিয়ে দেন মিল মালিকরা। যে যাই বলুক মান ধরে রাখা সম্ভব না। জানুয়ারির আগে বই সরবরাহ করা যাবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে শহিদ সেরনিয়াবাত বলেন, আমি সন্দিহান। তবুও চেষ্টা থাকবে সরকারের ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রাখতে। এ বিষয়ে আমাদের চেষ্টা থাকলেও কতটা সম্ভব হবে তা জানি না। কারণ টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
তিনি বলেন, মিল মালিকরা কারো অধীনে ব্যবসা করেন না। তাদের অগ্রিম টাকা দিলেও কাগজ পাওয়া যায় না। তারা অনেক শক্তিশালী। তাদের মধ্যে ইউনিটি আছে। সুতরাং তারা কারো নির্দেশে কাগজ দেবেন না। অনেক সময় দেখা গেছে- আমাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে বছরের মাঝামাঝি সময়ে দামবৃদ্ধি করে দিয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারিনি। কাজেই মিল মালিকরা কাগজ দিতে আশ্বস্ত করলেও আমরা নিশ্চিন্ত না।
নির্ধারিত সময় ও চুক্তি অনুযায়ী বই সরবরাহ করতে না পারলে প্রেস মালিক ও প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে বলে যে আলোচনা রয়েছে সে প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি বলেন, প্রতিবছরই এ কালো তালিকার কথা বলা হয়, কিন্তু করা হয় না। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে নিম্নমানের বই দেয়, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে আমরা সুপারিশ করি। কিন্তু বোর্ড বা মন্ত্রণালয় তা করে না। এর পেছনে চাপ, সুপারিশ ও অনৈতিক লেনদেন থাকতে পারে। নির্ধারিত সময়ে বই ছাপার কাজ শেষ না হওয়ার যেসব কারণ রয়েছে তার একটি হলো ছাপাখানার বকেয়া বিল পরিশোধ না হওয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবির সমন্বিত সভায় বিষয়টি নিয়েও আলোচনাও হয়েছে। যেসব ছাপাখানা মালিকরা নির্ধারিত সময়ে বিল না পাওয়ায় বই ছাপাতে অপারগতা জানিয়েছেন, তাদের বিল ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে পরিশোধ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। ২০২২ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ কাজের বিল বকেয়া রয়েছে এমন একটি ছাপাখানা আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেড। আগের শিক্ষাবর্ষের ২০ শতাংশ পাওনা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের ( তৃতীয়, চতুর্থ, ও পঞ্চম শ্রেণি) পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই কাজ করার অক্ষমতা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বকেয়া বিল পেতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭২ টাকা পাওনার কথাও জানিয়েছে আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেড।