মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম প্রণয়নে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০৫ পিএম, ১৮ এপ্রিল,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০২:০৬ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
মাধ্যমিক স্তরে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়নে ২০১৮ সালের ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন’ ও ‘শুদ্ধাচার’ মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের ৬২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পাইলটিং শুরু করা হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি) থেকে বিস্তৃত শিক্ষাক্রমের অনুমোদন নেয়া হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেয়া শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে পাইলটিংয়ের মাধ্যমে ভুলত্রুটি সংশোধন করে বিস্তৃত শিক্ষাক্রমের অনুমোদন নেয়া হবে এনসিসিসি থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইনের ১৬ ধারায় ‘পাঠ্যপুস্তক’ অংশে বলা হয়েছে ‘বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রণীত ও প্রকাশিত নয়, অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয়, এরূপ কোনও পুস্তককে কোনও বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না।’ অথচ বিস্তৃত শিক্ষাক্রমের অনুমোদন নেয়া হয়নি এবং পাঠ্যবই তৈরি করে ৬২টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাইলটিং শুরু করা হয়েছে।
বিস্তৃত শিক্ষাক্রম অনুমোদন নেয়া হয়নি স্বীকার করে এনটিবিরি চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্বে) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, আমরা এখন ৬২টি বিদ্যালয়ে পাইলটিং করছি। আসলে পাইলটিং করাই হয় কারিকুলাম যথার্থ আছে কিনা, যদি দোষ-ত্রুটি থাকে, তাহলে যেন সংশোধন করতে পারি। অনুমোদনটা হবে পাইলটিংয়ের প্রাথমিক ফলাফল পাওয়ার পর। তারপর আমরা বিস্তৃত শিক্ষাক্রমের অনুমোদন নেবো। প্রথাগত অনুমোদন হবে তখন, যখন পরিমার্জিতটা পাইলটিংয়ের মাধ্যমে নিতে পারবো। পাইলটিংয়ের আগে কোথাও যদি অনুমোদন হয়ে যায়, তাহলে সেটা রিজিড হয়ে গেলো। আগে অনুমোদন নিয়ে তারপর পাঠপুস্তক বিদ্যালয়ে দেয়ার বিধান আছে আইনে, তাহলে পাইলটিংয়ের জন্য বই কীভাবে করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে মশিউজ্জামান বলেন, সারা দেশে যখন শিক্ষাক্রম চালু করবো, তখন অনুমোদন নিয়েই যাবো। এনসিটিবির রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান এই বক্তব্য দিলেও বিগত সময়ের রীতি এবং ২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী, বিস্তৃত শিক্ষাক্রমের আগে অনুমোদন নিতে হবে। পাইলটিংয়ের পর আবারও চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়ার রীতি রয়েছে। এই রীতির বাইরে গিয়ে শুদ্ধাচার লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম : আইন ও শুদ্ধাচার মানার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেয়া রূপরেখা অনুযায়ী প্রাথমিকের বিস্তারিত শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছে। বিস্তৃত শিক্ষাক্রম গত মার্চ মাসে অনুমোদন দিয়েছে এনসিসিসি। বই তৈরির কাজ চলছে। বই তৈরি হলে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের পর পাইলটিং শুরু হবে। পাইলটিংয়ের পর কোনও সমস্যা দেখা দিলে, তা পরিমার্জন করে আবার এনসিসিসি থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়া হবে। তারপর সারা দেশে প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২৩ সালে। তবে তাও দেয়া হবে পরীক্ষামূলক সংস্করণ হিসেবে। শিখন ও শিখন পদ্ধতি নিয়ে ঠান্ডা লড়াই : শিখন ও শিখন পদ্ধতি নিয়ে এনসিটিবির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উইংয়ের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে শিক্ষাক্রম তৈরির শুরু থেকেই। তবে এই লড়াই দূর করতে ২০২১ সালের মে মাসে ভার্চুয়াল সভায় সিদ্ধান্ত নেয় হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তে বলা হয় পঞ্চম শ্রেণির প্রান্তিক যোগ্যতার বিষয়গুলো শিক্ষাক্রম রূপরেখার মেট্রিক্সে বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো প্রাথমিক উইং যে পর্যায়ে হস্তান্তর করবে, সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হবে। ২০২১ সালের ৬ জুন প্রাথমিক স্তরের পঞ্চম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইংকে সরবরাহ করা হয়েছে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য ও শিক্ষাক্রম সদস্য পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করবেন। সিদ্ধান্ত দুটিতে সই করেন এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান (রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান), প্রাথমিক শিক্ষাক্রম সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ওই সময়ের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম।
শিক্ষাক্রম ও শিখন পদ্ধতি : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতাভিত্তিক। তবে মাধ্যমিক স্তরের জন্য এই প্রথম যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। জোর দেয়া হয়েছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের। এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকের যোগ্যতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রমে শিখন পদ্ধতি হচ্ছে ‘সক্রিয় শিখন’। আর মাধ্যমিকের যোগত্যাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে শিখন পদ্ধতি হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’। এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীকে স্কুলের বাইরে নেয়ার সুযোগ সীমিত। সে কারণে সক্রিয় শিখন পদ্ধতি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত রূপরেখা অনুযায়ী। তাছাড়া অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতি আর সক্রিয় শিখন পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, বিদ্যালয়ের পাঠ বিদ্যালয়েই শেষ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়নে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং যৌথভাবে কাজ শুরু করে। অভিন্ন ভিশন, মিশন, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, মূল যোগ্যতা, শিখন ক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতা এবং বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। অভিন্ন শিখন ক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতা থেকে প্রাথমিক স্তরের জন্য বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের জন্য যৌথভাবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম কমিটির মাধ্যমে বিস্তৃত শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর জানায়, পাঁচ বছরব্যাপী মাঠ পর্যায়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রায় ৩০ বছর আগে প্রাথমিক স্তরে সারা দেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। পরবর্তীতে ২০০২ এবং ২০১২ সালে দুইবার এ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আওতায় ২০১৭ সাল থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা, চাহিদা যাচাই ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১২ সালেও পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের আগে শিক্ষাক্রমের অনুমোদন নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এবারেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের আগে এনসিসিসি কর্তৃক অনুমোদন করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ছিল উদ্দেশ্যভিত্তিক। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে এবারেই প্রথম মাধ্যমিক স্তরেও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমটি আগে থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক থাকায় এটি পরিমার্জন করা হয়েছে, নতুন করে প্রণয়ন করা হয়নি। সক্রিয় শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন : জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরেই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে সক্রিয় শিখন-শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। সক্রিয় শিখনের আওতায় যোগ্যতার ধরন, শিক্ষার্থীর বয়স ও পরিপক্কতা অনুযায়ী অনুসন্ধানমূলক, সমস্যা সমাধানমূলক, প্রকল্প ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে। কাজেই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন সক্রিয় শিখনের একটি অংশ। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে পদ্ধতিগত কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি।