যে কারণে ফ্যাটি লিভার ডিজিজে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:১৮ পিএম, ১৩ মে,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১১:২৫ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
সাতাশ বছর বয়সী ওয়াহিদা জামান অন্য একটি অসুখের জন্য নিয়মিত পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানতে পেরেছেন তার ফ্যাটি লিভার ডিজিজ রয়েছে।
পরিবারে আরো দুজন ব্যক্তি এতে আগে থেকেই আক্রান্ত। তাদের ক্ষেত্রেও যা ধরা পড়েছে অন্য অসুখের জন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়ে অথবা অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে।
পরিবারের একজন সদস্য আগেই মারা গেছেন লিভার সিরোসিসে, ফ্যাটি লিভার যার অন্যতম কারণ।
তিনি বলছিলেন, ‘আমার নানু এবং আম্মুর এই সমস্যা রয়েছে। নানা মারা গেছেন লিভার সিরোসিসে। তিনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন। বুকে ব্যথা উঠলেই বলতেন অ্যাসিডিটি। আমার আম্মুও তাই ভাবতো। অ্যাসিডিটির জন্য একটা ওষুধ খেয়ে নিত। বিষয়টা তারা কেউই গুরুত্ব দেয়নি।’
তবে ওয়াহিদা জামান বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন, ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি সম্পর্কে পড়েছেন এবং প্রাথমিক পর্যায়েই তা থামিয়ে দিতে ওজন ও খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন।
‘এখন বুঝতে পারছি এটা হয়ত আমাদের পরিবারের কোনো জিনগত ব্যাপার। আমি একজন ইন্টারনাল মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার আমাকে বলেছেন আমার ক্ষেত্রে ওবেসিটি (স্থূলতা) এটার কারণ। আমাকে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন। এখন যেটা করছি, আমরা পোলাও, গরুর মাংস এরকম তৈলাক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ওজন কমানোর চেষ্টা করছি।’
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ কী :
নামই সম্ভবত বলে দেয় এই অসুখটি হলে আসলে কী ঘটে। একজন ব্যক্তির যকৃতে দরকারের চাইতে বেশি চর্বি জমে গেলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বলা হয়।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা এনএইচএস বলছে, যকৃতে কিছুটা চর্বির উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ব্যক্তির যকৃতের যে ওজন, তার ১০ শতাংশের বেশি যদি চর্বি হয় তখন সেটিকে ফ্যাটি লিভার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সংস্থাটি বলছে, যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি তাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি, বিশেষ করে যাদের শরীরের মাঝখানের অংশে, পেটে অনেক চর্বি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে। এই ধরনের ব্যক্তিদের শরীরকে আপেল আকৃতির শরীর হিসেবে বর্ণনা করেছে এনএইচএস।
এছাড়া যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি রয়েছে তাদের ঝুঁকি বেশি।
কিন্তু এসব অসুখ নেই এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ছে। এমনকি শিশুদের মধ্যেও এটি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে এনএইচএস।
একসময় বলা হতো এটি মদ্যপায়ীদের অসুখ। অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানের কারণে লিভারে যেসব অসুখ ধরা পড়ে তার সাথে এটির মিল থাকলেও অ্যালকোহলের সাথে একদমই কোনো সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যেও এর প্রবণতা গত কয়েক দশক ধরে বাড়ছে।
তাই এর আলাদা নাম দেয়া হয়েছে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ।
শুরুতে যার লক্ষণ নেই :
ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফারুক আহমেদ বলছেন, দীর্ঘদিন কারো ফ্যাটি লিভার থাকলে লিভার ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এর ফলে যকৃতে ফাইব্রোসিস, ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে।
তিনি বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এর কোনো লক্ষণ নেই। একদম শুরুতে কোনো সমস্যা হয় না। তাই রোগীরা বুঝতে পারে না। অন্য কোনো সমস্যার কারণে চিকিৎসকের কাছ গেলেই বেশিরভাগ সময় এটি ধরা পড়ে। এর জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম ও রক্ত পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। তবে এরপরের ধাপগুলোতে লক্ষণ শুরু হয়।
সেগুলো সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তিনি বলছেন, পেটের উপরের ডান দিকে, বুকের খাঁচার নিচে ডান দিকে ভারি লাগবে, একটা ব্যথা হবে। ক্লান্ত ও দুর্বল লাগবে সব সময়। ওজন কমতে থাকবে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যদি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যায় তাহলে চোখের সাদা অংশ ও ত্বক হলুদাভ হয়ে যাবে, জন্ডিস হবে, ত্বকে চুলকানি দেখা দিতে পারে। পেট, গোড়ালি, পা ফুলে যাবে, রক্তবমি, কালো পায়খানা হবে। এগুলো খুব অ্যাডভানস স্টেজে হয়।
বাংলাদেশে এর প্রবণতা :
অধ্যাপক আহমেদ বলছেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বে এর প্রবণতা অনেক বেশি হলেও আমরা ইদানীং দেখছি আমাদের কাছে ফ্যাটি লিভার নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি রোগী আসছেন। এমনকি গ্রামের মানুষ তাদেরও এটি হচ্ছে। আমরা ভাবি যে, শহরের মানুষ মোটা হয়ে থাকে আর গ্রামের মানুষ কায়িক পরিশ্রম করে বেশি তাই তাদের ওজন কম। কিন্তু আমাদের নিজেদের গবেষণা আছে। এমনকি গ্রামেও অনেকের ফ্যাটি লিভার পেয়েছি আমরা।’
অধ্যাপক আহমেদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে।
যেভাবে সাবধান হবেন :
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস মেডিসিন বলছে, এটি এমন এক রোগ যা নীরবে লিভার বা যকৃতের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর লিভারের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অন্য সকল অঙ্গের সুস্থতা।
জন হপকিনস মেডিসিন বলছে, ফ্যাটি লিভার সারিয়ে তোলার কোনো ওষুধ নেই। কিন্তু লিভারের নিজেকে সারিয়ে তোলার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে।
সে জন্য অবশ্য দরকার জীবনাচরণ পরিবর্তন করা, লিভারে চর্বি জমার কারণগুলো নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর খারাপ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো প্রতিরোধ করা যায়। সূত্র : বিবিসি