আমার চেয়ে গরিব আর কেউ নেই সিলেটে : সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:১৪ পিএম, ১৩ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:২৮ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, দেশের বেসামরিক (সাধারণ) মানুষ এখনো রাস্তায় বের হলে আমাকে চিনে ফেলে। গত পরশু ফার্মগেটের ফুটপাতে হাঁটছিলাম, তখন এক তরকারি বিক্রেতা এগিয়ে এসে বলে, স্যার, আপনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন ছাড়লেন? আপনি মন্ত্রণালয় ছাড়ায় দেশে লেখাপড়া হচ্ছে না, আমাদের সন্তানরা ভালো পড়াশোনা করতে পারছে না। অনেকেই আমাকে এটা বলেন।
ব্যাপারটা যেন এমন, আমি ইচ্ছে করে মন্ত্রণালয় ছাড়ছি, আবার চাইলেই আসতেও পারব। এটা আসলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা। তাদের মনে হয়, আমি মন্ত্রণালয় ছেড়ে দিয়ে শিক্ষার ক্ষতি করেছি। আসলে আমি ক্ষতি করেছি বা অন্য যিনি দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি ক্ষতি করেছেন ব্যাপারটা এমন না।’
মঙ্গলবার (১১ জুন) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলনে’ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা দুই শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগের বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘যে কোনো পরিবর্তন এলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। হয়তো সেই পরিবর্তনের ইতিবাচক ফলটা তাৎক্ষণিক না পেয়ে অনেক অভিভাবক অসন্তুষ্ট থাকেন। সেজন্য অনেকে রাগ-ক্ষোভ থেকে অভিযোগ করে থাকেন। এটা একটা সমস্যা। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে কী কী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, ‘আগে মেয়েরা পিছিয়ে ছিল। স্কুলে আসতে চাইত না। আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। উপবৃত্তি পৌঁছে দিয়েছি। তখন এতটা সহজও ছিল না। তার ফল এখন পাচ্ছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘এসএসসি পর্যন্ত এখন আমাদের দেশে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া করছে, বেশি ভালো ফলাফল করছে। মেয়েরা কোথায় ছিল, আর এখন কোথায় পৌঁছে গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আগে তো অত বড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও ছিল না। মেয়েদের ভালো ফল করার সুবাদে সবার কাছে বড়সড় বলে গণ্য হয়েছে। দেশ-বিদেশে আলোচনা হয়েছে। তখন সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার আগে অত গুরুত্ব পেত না।’
তার বক্তব্যের আগে সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ২৯ লাখ প্রতিবন্ধীকে মাসে এক হাজার টাকা করে দেয় সরকার। কিন্তু সেই টাকা তারা পায় না। তাদের বাবা বা চাচারা খরচ করে ফেলে। আমরা যখনই কোনো প্রতিবন্ধীকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমার সবচেয়ে কাছের কে, সে বলেছে তারা মা। কিন্তু এই মায়ের কাছে কোনো টাকা যায় না।
বিষয়টির উল্লেখ করে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমি যখন মন্ত্রী, তখন মায়েদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। তখন একটাই মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মায়ের নামে একটি টেলিফোন থাকবে, সেই ফোনেই টাকা যাবে। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেল, ২৫ হাজার মায়ের মোবাইল নেই। অন্যরা হয়তো ভাইয়ের বা আত্মীয়ের নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সরাসরি টাকা যাওয়ার জন্য আমরা ৪০ হাজার মা-কে মোবাইল কিনে দিয়েছি। এজন্য যে, মা কখনো বাচ্চার টাকা খরচ করবে না।
সিলেটের এই সংসদ সদস্য বলেন, এখন অনেকে বলছেন, টাকাটা কম। কিন্তু টাকা যে পরিমাণ ছিল, সেটা উৎসাহজনকই ছিল। এখন টাকার দাম কমে গেছে, কোটিপতি ছাড়া কাউকে গণ্যই করে না। কিন্তু সিলেট জেলার মধ্যে আমার চেয়ে গরিব কেউ নেই। আমি কোটিপতি তো না-ই, লাখপতিও না, হাজারপতিও না, আমি শতপতি। যার ফলে আমি গরিব মানুষ।
তিনি বলেন, এখন ৫০০ টাকা কিছুই না। এটি ঠিক যে, আগের তুলনায় এই টাকা কম। এটি বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করব। টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার সমস্যাও রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, করোনাসহ নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে। ইচ্ছা করলেই এটা বাড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হবে না। আমি সত্যটাই প্রকাশ্যে বলে ফেললাম। কিন্তু দেশ যে এগিয়ে গেছে, সেটাই আমাদের আশা।
ফেলের হার বাড়ছে উল্লেখ করে সাবেক এ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, তখনও অনেক শিক্ষার্থী ফেল করতো। অনেক স্কুল ছিল বিভিন্ন বোর্ডের অধীনে, সেটা ২০-৩০ থেকে ৪০টা পর্যন্ত থাকত যেখানে একজনও পাস করত না। কিন্তু এবারের তথ্যে আমি বিস্মিত। এ বছর ৩ লাখের বেশি ফেল করেছে। ৫১টা স্কুলের কেউ পাস করেনি। আরও মর্মান্তিক খবর আছে ফলাফলের মধ্যে। সেগুলো বলছি না। উল্লেখ করলেও মনটা খারাপ হয়। তাহলে বুঝে নেন আমরা এগোচ্ছি, না কি পেছাচ্ছি। এসব দিকে আমাদের আরও নজর দেওয়া দরকার।’
তিনি বলেন, আমাদের যে লক্ষ্য ছিল সেখানে আমরা যেতে পারিনি। সব বিএ, এমএ পাস করে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত চায়, লোক নিবে ৩৫ জন, আবেদন করেছে ৭ লাখ বিএ, এমএ পাস প্রার্থী। পরীক্ষাই নেয় না তারা, কার পরীক্ষা নিবে, কীভাবে পরীক্ষা নিবে। স্থগিত হয়ে যাওয়ায় পদ শূন্য থাকে। বিএ, এমএ পাস করে বিদেশেও যায়, সেখানে জিজ্ঞেস করে কি জানো? বলে যে, আমি এমএ পাস। এমএ পাস তো কি হয়েছে, যাও কামলার কাজ কর। তাই আসলে কোনো না কোনো দক্ষতা, কোনো না কোনো জ্ঞান থাকতে হবে। যে জ্ঞান কাজে লাগানো যায়, সেই শিক্ষা আমরা দিব। সব জায়গায় কারিগরি শিক্ষা আমরা ঢুকিয়ে দিব।
নাহিদ বলেন, আমি যখন প্রথম মন্ত্রী হয়েছি, তখন জরিপ করে দেখেছি মোট শিক্ষার্থীর মাত্র দশমিক ৮ শতাংশ কারিগরিতে পড়ে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার পরে সম্ভবত জার্মানীই তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। সেখানে ৮৫ শতাংশ মানুষ কারিগরিতে পড়ে। জার্মানি কোথায় আর আমরা কোথায়! সেজন্য আমরা ২০২০ সালের আগেই আমরা ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে নিয়ে যাব। ২০১৯ সালের মধ্যেই আমরা ১৭ শতাংশে চলে গেলাম। পর্যায়ক্রমে অর্ধেক স্কুলকে এক ধরণের কারিগরি স্কুল বানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু আমি ছিলাম না, সেটিও আর সফল হয়নি।
সম্মেলনে সকালের অধিবেশনে অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক সচিব এন আই খান, সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। এ ছাড়াও বক্তব্য শেষে বাঁশি বাজিয়ে এবং সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।
বিকেলে দ্বিতীয় ও শেষ অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সংসদ সদস্য এম এ মান্নান ও আরমা দত্ত। বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীদের এভারেস্ট বিজয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প শোনান এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত এবং অনুপ্রেরণাদায়ক সংগীত পরিবেশন করেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী নকীব খান ও ফাহমিদা নবী। সম্মেলনে দেশের ৪২ টি জেলা থেকে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক অংশগ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। বর্তমানে তিনি সিলেট-৬ (বিয়ানী বাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। এ ছাড়া তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি।