উপজেলা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ, ভোটে আনতে চায় বিএনপিসহ অন্য দলগুলোকে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৫৫ এএম, ২৩ মার্চ,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০১:৪৮ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কারণ, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনটিকে দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় ক্ষমতাসীনেরা। দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে বিএনপিসহ বিরোধীদের ভোটে আনাও অন্যতম লক্ষ্য।
উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অনেক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। দলটি প্রকাশ্যে বলছে, জাতীয় নির্বাচনের পর তৃণমূলে বিভেদ কমাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, এর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা বেকায়দায় বা ‘ট্র্যাপে’ ফেলাও তাদের লক্ষ্য। যেমন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর বিএনপি উপজেলা বা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করলে তাদের দলের অনেকেই স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেবেন। আবার উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল, এমনটা প্রমাণিত হবে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মাঠের জরিপ হচ্ছে—তাদের এই কৌশল কাজে দিয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে তৎপর হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচনসহ যে কটি পৌরসভায় ভোট হয়েছে, এর অনেকগুলোতেই বিএনপি থেকে বহিস্কৃত নেতারা প্রার্থী হয়েছিলেন। এমনকি ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বি এম আনিছুজ্জামানের স্ত্রীকে হারিয়ে বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে , বিএনপির নেতারা অংশ নিলেও উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশি জয়ী হবেন বলে তাঁরা মনে করেন। তবে কিছু কিছু উপজেলায় বিএনপির নেতারা জয়ী হলে তো অসুবিধা নেই। বরং এতে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। ওই নেতা আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচনায় এসেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়লে সংসদ নির্বাচনের ভোটের হার নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার কিছুটা অবসান হতে পারে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রের দাবি, বিএনপির নেতারা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভেদের ফলে সংঘাতের আশঙ্কা কমে যাবে। কারণ, তখন বিএনপির প্রার্থীকে হারাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করবেন। এমনকি দলের নেতাকে জয়ী করতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে একজনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে। আর বিএনপির প্রার্থী না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতারা বেশি সংখ্যায় প্রার্থী হবেন। এতে সংঘাত আরও বাড়তে পারে।
"সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির নেতারা (সাবেক বা বহিস্কৃত) অংশ নিয়েছেন। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপির নেতারা অংশ নেবেন বলে তাঁদের প্রত্যাশা"। -আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
স্থানীয় সরকার ভোট নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলকেন্দ্রিক আরেকটি চিন্তা কাজ করেছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী বছরজুড়ে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্য বিরোধী দলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিলে তারা আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেতে পারবে না। আবার বিরোধীরা বর্জন করলে তাদের দলের নেতারা নিজ উদ্যোগে নির্বাচনে অংশ নেবেন। দলও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এতে তৃণমূলে বিএনপি আরও দুর্বল হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির নেতারা (সাবেক বা বহিস্কৃত) অংশ নিয়েছেন। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপির নেতারা অংশ নেবেন বলে তাঁদের প্রত্যাশা।
এবার উপজেলা নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২৩ মে, তৃতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৫ জুন।
দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে দলীয় প্রতীকে ৪৭৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ অতীতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে।
২০১৯ সালে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৭৩টি উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। এর মধ্যে ১১৫ জন নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হন ১৩৬ জন, এর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক। বিএনপিরও অনেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত
উপজেলার ভোট নিয়ে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় জোরালো মত হচ্ছে ভোটে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তবে দলটির নেতারা মনে করছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যরা কিছুটা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ কিছু কিছু স্থানে সংসদ সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ মিলে একক প্রার্থী ঠিক করার চেষ্টা করছে। এতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বাধা দেবে না। তবে এই নিয়ে যাতে সংঘাত না হয় কিংবা কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে না পারে, সেটি তদারক করবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
"নেত্রী কাউকে প্রতীক দেননি। এখন যে যার যার মতো প্রার্থীকে সমর্থন দেবে"। -নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় কমিটির মূল দায়িত্ব হবে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করা। তারা বিভেদ দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন জেলার নেতারা গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এসব সাক্ষাতে উপস্থিত সূত্র বলছে, সাক্ষাৎ–প্রার্থীদের বেশির ভাগই উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে দিকনির্দেশনা নিতে এসেছিলেন। দলীয় প্রধান সুনির্দিষ্ট কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। বরং স্থানীয়ভাবে ঐক্য ধরে রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, জনপ্রিয় প্রার্থীরা যাতে জয়ী হয়ে আসতে পারেন, এ জন্যই তিনি দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেননি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নেত্রী কাউকে প্রতীক দেননি। এখন যে যার যার মতো প্রার্থীকে সমর্থন দেবে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা, অনেক উপজেলায় সংসদ সদস্যদের সন্তান, স্ত্রী, ভাই, শ্যালকেরাও প্রার্থী হবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাতে পারেন। তবে সেটা দলীয়ভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে দলটির নেতারা বলছেন।