জাতীয় সংসদকে ‘একদলীয় ক্লাবে’ পরিণত করেছেন সরকার : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৪৮ এএম, ২৩ জানুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৭:৩৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
জাতীয় সংসদকে সরকার ‘একদলীয় ক্লাবে’ পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ সোমবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘‘আপনারা দেখুন গণতান্ত্রিক যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ওরা (সরকার) ধ্বংস করেছে। পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট কি? এখন যে পার্লামেন্ট তারা তৈরি করেছে একটা কোনো পার্লামেন্ট। এটা একদলীয় একটা ক্লা্ব তৈরি করেছে। ইটস এ ক্লাব অব আওয়ামী লীগ।”
নির্বাচনী ব্যবস্থার ধবংস করে দিয়েছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের গেটওয়ে হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা। নির্বাচন করে আপনি দেশ চালনার জন্য পার্লামেন্ট তৈরি করবেন, মন্ত্রিসভা গঠন করবেন… তাই না। সেই নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে তারা ধবংস করে দিয়েছে। মানুষ ভোটই দিতে যায় না। ভোট দিয়ে কি হবে? ভোট তো আমার থাকবে না, আমার ভোট তো অন্য নিয়ে যাবে। এজন্য যতকিছু কারসাজি করা দরকার তারা(সরকার) করেছে। কখনো ১৫৪ জনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষণা করে দেয়া, কখনো যে তারিখে ভোট তার আগের রাত্রে ভোট নিয়ে নেওয়া, ভোট করে নেওয়া এবং সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে তাদের পক্ষে ঘোষণা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা। এই যে কাঠামোটাকে তারা নষ্ট করেছে।”
২৭ দফার রুপরেখাকে বিএনপির স্বপ্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিশ্চয় এটা জনগনের সামনে তুলে ধরব। এটা একটা ড্রিম। ড্রিম ছাড়া কখনো সফল হওয়া যায় না। আমরা স্বপ্ন দেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে, তিনি সঠিক সময়ে দলকে সঙ্গে নিয়ে এই রুপরেখা জনগনের সামনে উপস্থাপন করেছেন এবং ইতিমধ্যে আমাদের জনগনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদকে বলব, এ বিষয়ে সারাদিন ধরে ওয়ার্কশপ করুন। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পেশাজীবীদের নিয়ে মতামত নিয়ে আমরা যেন পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দিতে পারি সেজন্য উদ্যোগ নেবেন।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের উদ্যোগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত ‘রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা’র ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়। গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রুপরেখা ঘোষণা করা হয়।
‘জনতার টেউ শুরু হয়েছে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘প্রত্যেকটা জিনিসের উত্থান-পতন আছে, সামনে আগানো, পেছানো যাওয়া.. সেই টেউয়ের মতো। যে টেউ শুরু হয়েছে উত্তাল তরঙ্গের মতো, সমুদ্রের মতো এরা ভেসে যাবে। কারণ এদের সাথে জনগন নাই, জনগন থাকবে না। আমাদের শেষ কথা ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য আমরা যে ১০ দফা দিয়েছি সেই ১০ দফার প্রথমেই এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই সরকার অবৈধ সরকার। সংসদকে বিলুপ্ত করতে হবে। এই সংসদের কোনো মূল্য নেই এবং একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে সেই সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন গঠন করে নতুন নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আমরা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হব।”
‘হতাশ হবেন না’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘অনেকের কথায় আমি হতাশার একটু ছাপ পাই খুঁজে। কেনো হতাশ হবে? আমরা তো সাকসেসফুল হচ্ছি, প্রতিটা স্টেপে আমরা এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমি জেলে গেছি আমি একা জেলে যাইনি তো। হাজার হাজার আমাদের নেতা-কর্মী জেলে গেছেন। তাদের মুখে আমি এতটুকু হতাশার ছাপ দেখিনি। কারণ এই লড়াইটা শুধু আমার লড়াই নয়, এই লড়াইটা আমার দেশের লড়াই, এই গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার শুধু আমার জন্য নয়, সমগ্র মানুষের জন্য জাতির জন্য। দুর্ভাগ্য আমাদের আজকে ৫০ বছর পরে এসে আমাকে এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটা অসম লড়াইয়ের মধ্যে আছি। আমাদের প্রতিপক্ষ যারা তারা প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাশালী। তাদের হাতে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, তাদের হাতে বন্দুক, তাদের হাতে পিস্তল-গ্রেনেড। অবলীলাক্রমে তারা সেগুলো মারে, উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়। আমাদের নয়া পল্টনের অফিসের সামনে মকবুল হোসেন(স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা) প্রকাশ্যে গুলি করে মারলো। উল্টো মামলা দিলো আমাদের সাড়ে ৪‘শ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। তার মধ্যে আমান উল্লাহ আমানও এক নাম্বার আসামী। আর আমরা আসামী না থাকলেও নাকী হুকুমদাতা নির্দেশদাতা। তাই মূল বিষয়টা হচ্ছে, আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হবে, আমাদের জনগনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে হবে… ।”
‘পুরো বিচার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘পুরো জুডিশিয়াল সিষ্টেমকে তারা দলীয়করণ করে ফেলেছে। যে হাইকোট জামিন দেয়, ৬ সাপ্তাহের জামিন দিচ্ছে। নিম্ন আদালতে গেলে সেই জামিন বাতিল করে দিয়ে কারাগারে পাঠায়। চিন্তুা করতে পারে। যে হাইকোর্ট বলছেন যে হ্যাঁ তাকে জামিন দেয়া হলো, অন্তবর্তীকালীন ৬ সাপ্তাহের জন্য দেয়া হলো এখন সে নিম্ন আদালতে গিয়ে সারেন্ডার করবে। দেট ইজ দ্যা ইন্ডিগেশন যে তাকে জামিন দিতে হবে। হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছে। অথচ নিম্ন তাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মতো যারা রাজনীতি করি বলে হয়তবা একটা প্রিভেলেজ পাওয়া যায়। আমাদের জামিন আবেদন নিম্ন আদালত নামঞ্জুর করে দেয়। কি রকম দেখেন? হাইকোর্ট যখন আমাদের জামিন দিলো সেই জামিন বাতিল করার জন্য আপীল করে… । পরিস্কার করে বলা হচ্ছে যে, হাইকোর্টের দায়িত্ব কী? এই জামিন দেওয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার হাইকোর্টের। এরকম একটা নয় হাজার হাজার কেইস আছে।”
নিম্ন আদালতের কি হয় তা সবাই জানে বলেও মন্তব্য করেন ফখরুল।
‘গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিভাবে? উনার বলেন, সেলফ সেন্সরশীপ করেন। সেলফ সেন্সরশীপ কেনো করে? যারা মালিক তারা তো বিজনেস হাউজ। তাদেরকে ব্যবসা করতে হয়, তাদেরকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে এবং প্রত্যেকটা মিডিয়া হাউজের সঙ্গে একজন করে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। কি লিখবে, হেডলাইন কোনটা যাবে, কোনটা প্রাধান্য দেয়া হবে, কোন প্রাধান্য দেয়া হবে না –সব কিছু নির্দেশ করে দেয়া হয়।”
তিনি বলেন, ‘‘এখন আফটারঅল মানুষকে তো করে খেতে হবে। সাংবাদিকরা চাকুরি করেন ওটাই তো তাদের আয়-উপার্জন, তাদের তো আকাশ থেকে টাকা এসে পড়ে না, তাদেরকে চাকুরি করে খেতে হয়। ওই ঝুঁকি নিতে পারেন না সবসময় যে চাকুরি গেলেও আমি আপনার ছোট কথাটা লেখবে, সবসময় পারেন না। তারপরেও তারা লিখছেন। তারপরেও তারা ওই বরিশালের মাঠে(বিভাগীয় সমাবেশে) মরিয়ম বিবি তিনদিন আগে থেকে বসে আছেন বক্তৃতা শুনার জন্য, বিএনপির কথা শুনার জন্য। কেনো? সে বলছেন যে, আর তো পারছি না বাবা। এখন পরিবর্তন চাই, খালেদা জিয়া ভালো মানুষ ছিলেন তার দলটা হয়ত কিছু পরিবর্তন দিতে পারে। এটাই হচ্ছে ওই সাংবাদিক ভাইয়েরা ওই ছবিগুলো ওই কথাগুলো নিয়ে আসছেন। এজন্য তাদেরকে স্যালুট করে এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই কাজগুলো করছেন।”
তিনি আরোও বলেন, ‘‘চিন্তা করতে পারেন সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা, ১০০টা মামলা, হত্যা মামলা এবং আমাদের সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির এখন পর্যন্ত বিচার হয় নাই।এরকম অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। আলোকচিত্রী সাংবাদিক শহীদুল আলমের ওপর নির্য্তনের কথা জানেন, সাংবাদিক রোজিনার নির্যাতনের কথা জানেন… প্রতি পদে পদে নির্যাতন… গুম। তারপরেও সাংবাদিকরা এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনগনের কথা বলছেন, মানুষের কথা বলছেন।।”
‘দেশের জনগনের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে অপমান করে সপ্তম শ্রেনীসহ বিভিন্ন শ্রেনীর নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর নিন্দা এবং ওইসব বই প্রত্যাহারের দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম, অধ্যাপক কামরুল আহসান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাম হাফিজ কেনেডী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বক্তব্য রাখেন।
এই আলোচনায় পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে জিয়া পরিষদের জিয়া পরিষদের অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, শিক্ষক কর্মচারি ঐক্যজোটের অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, জাকির হোসেন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের ডা. রফিকুর ইসলাম বাচ্চু, এগ্ররিকালরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এ্যাবের আসাদুজ্জামান চুন্ন, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোটের রফিকুল ইসলাম এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের শহীদুল ইসলাম তাদের মতামত তুলে ধরেন।